ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে একটি ঐক্যভিত্তিক ও সহনশীল রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হবে এমন প্রত্যাশা ছিল মানুষের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে সেই প্রত্যাশা আরও জোরালো হয়েছিল। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বিভাজন, পারস্পরিক দোষারোপ ও আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে সেই আশার জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে রাজনৈতিক জোট দেশ ঐক্য।
রোববার (২৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর পরিবাগে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে আয়োজিত ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ ঐক্য’র ভাবনা দেশবাসীর নিকট উপস্থাপন’ শীর্ষক সভায় জোটের নেতারা বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ হিসেবে উপস্থাপন করার মতো পরিবেশ দেশে তৈরি হয়নি।
বিজ্ঞাপন
সভায় সভাপতিত্ব করেন- দেশ ঐক্য’র ভাইস-চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শেখ মো. আকমল হোসেন, সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুর রহীম চৌধুরী। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) আবু ইউসুফ যোবায়ের উল্লাহ।
বক্তারা বলেন, বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা পেলে দেশ ঐক্য ৩০০ আসনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সবাইকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগও ছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় তারা নির্বাচনে যায়নি। পরবর্তীতে সেই সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত হওয়াকে তারা রাজনৈতিক বাস্তবতার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশ ঐক্য লিখিতভাবে একাধিকবার সংস্কার ও নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে পরামর্শ দিলেও সেগুলোর যথাযথ প্রতিফলন দেখা যায়নি বলে অভিযোগ করেন নেতারা। তাদের মতে, ড. ইউনূস অনেক ক্ষেত্রে সফল হলেও তার যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সফলতা নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে দৃশ্যমান নয়।
সভায় জানানো হয়, দেশ ঐক্য ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেবে না, তবে নির্বাচন পেছানোর পক্ষেও নয়। নেতারা বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত হলে নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন- নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হলে এবং প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে এখনও ১৯৯১ বা ১৯৯৬ সালের মতো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
বক্তারা আরও বলেন, কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হলে রাজনীতিবিমুখ, সংস্কারপন্থী ও যোগ্য নাগরিকরা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হতেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়ি ও অনিশ্চয়তা সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে।
সভা থেকে বিএনপি জোট ও জামায়াত জোটের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহিতা, ঐক্য ও সংস্কারভিত্তিক ২১ দফা দাবি অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়। দাবিগুলো হলো-
১) সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন থাকা।
২) সব রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত সংসদে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণ।
৩) ধর্ম ও দল নির্বিশেষে সহনশীলতা ও সম্প্রীতি চর্চা।
৪) আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন।
৫) জনপ্রতিনিধি ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ জবাবদিহিতা।
৬) পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ।
৭) অনাবাদি জমি ব্যবহার ও কৃষিতে পরিকল্পিত উৎপাদন নিশ্চিত।
৮) বিনিয়োগ ও শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি এবং শ্রমিক কল্যাণ।
৯) রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সমস্যা সমাধান ও জীবনমান উন্নয়ন।
১০) এমপিদের দৈনিক ন্যূনতম ৮ ঘণ্টা জনসেবায় নিয়োজিত থাকা।
১১) দুর্নীতিমুক্ত থাকার শপথ ও বেতন-ভাতা অর্ধেক গ্রহণ।
১২) সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা।
১৩) অতীত সরকারের ইতিবাচক সংস্কার অব্যাহত রাখা।
১৪) কর্মক্ষম নাগরিকদের কর্মসংস্থান বা বেকার ভাতা প্রদান।
১৫) মুক্তিযোদ্ধাসহ সব সামাজিক ভাতা বহাল রাখা।
১৬) বিদেশে চিকিৎসা না নেওয়ার অঙ্গীকার।
১৭) সরকারি সব দপ্তরে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু।
১৮) ভবঘুরে ও অসহায় জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও খাদ্য নিশ্চিতকরণ।
১৯) চলমান অপরাধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন।
২০) রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি কাউন্সিল গঠন।
২১) দেশ ঐক্যসহ অন্যান্য দলের যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা।
সভায় বক্তব্য রাখেন— বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোজাম্মেল হোসেন ভূঁইয়া, সিএলএনবি’র চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ, রফিকুল ইসলাম, মহসিন মৃধা প্রমুখ।
বিইউ/এএস

