শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কেন জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে এনসিপি?

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:০৩ পিএম

শেয়ার করুন:

কেন জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে এনসিপি?
সমঝোতার বিষয়ে কয়েকটি দলের আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত কিছু চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে এনসিপি।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এর মধ্যেই ‘দল ও বড় অংশের নেতারা ভুল পথে হাঁটছে’ এমন অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেছেন দলটির একজন কেন্দ্রীয় নেতা।

জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা চূড়ান্ত হলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আরো কয়েকজন নেতার পদত্যাগের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এতে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে-দলের ভেতরে ঐকমত্য না থাকলেও কেন জামায়াতের দিকেই ঝুঁকছে এনসিপি?


বিজ্ঞাপন


রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, রাজনীতিতে ‘নতুন বন্দোবস্ত’ আনার প্রতিশ্রুতি, ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যের পরও শেষ পর্যন্ত কয়েকটি আসনের হিসাব কষে পুরোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সমঝোতার পথে হাঁটছে এনসিপি। এতে দলটি নিজের ঘোষিত অবস্থান নিয়েই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

যদিও এনসিপি নেতারা বলছেন, সমঝোতার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু চূড়ান্ত হয়নি। কয়েকটি দলের সঙ্গেই তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতের সঙ্গে তাদের অবস্থানগত সামঞ্জস্য থাকার কারণে দলটির সঙ্গে আসন সমঝোতার দিকে ঝুঁকছে তরুণদের নিয়ে গড়া দলটি।

তবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় আসন সমঝোতা না হওয়াও দলটির জামায়াতের কাছে ঘেঁষার একটা কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

এদিকে গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি এনসিপি দিয়েছিল, তার সঙ্গে দলটির কর্মকাণ্ডের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ফলে গতানুগতিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেও সমালোচনার মুখে পড়ছে দলটি।


বিজ্ঞাপন


রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচনী সমীকরণ থেকে ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতেই এনসিপি জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে। তবে এই সিদ্ধান্ত দলটির জন্য কতটা হিতকর হবে সে সন্দেহও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নে যা বলছে এনসিপি

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে চব্বিশ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাঠে সোচ্চার থাকা জুলাই আন্দোলনের পরিচিত মুখদের নিয়ে গঠন হয় নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি, যেখানে যোগ দিতে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগও করেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন ও পরিচালনা হচ্ছে’ প্রথম থেকেই এমন অভিযোগের মুখে পড়েছে এনসিপি। একইসঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন সময় একে ‘জামায়াতের বি টিম’ বলেও অভিযোগ উঠে।

তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনসহ সংস্কার পদ্ধতি নিয়ে জামায়াতের কিছু দাবির সঙ্গে মতপার্থক্য থাকায় দলটির নেতৃত্ব ইসলামপন্থি আট দলের যুগপৎ আন্দোলনে যায়নি এনসিপি।

তবে এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’- এরও ঘোষণা আসে। এর দুই সপ্তাহ পরই জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী আসন সমঝোতার আলোচনা সামনে এলো।

এ নিয়ে প্রশ্ন করলে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই একক, যৌথ বা আসন সমঝোতার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের বিষয়ে ওপেন ছিলাম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত এবং আরো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের জোট গঠন বা আসন সমঝোতার বিষয়ে এবং রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়নের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলমান রয়েছে।’

তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংস্কার প্রশ্নে কারা বেশি আগ্রহী এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সে বিষয়টিকেই এনসিপি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

‘ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গেই অন্য দলগুলোর মতভিন্নতা পরিলক্ষিত হতো। সেখানে সংস্কারের পয়েন্টগুলোতে ন্যাচারালি (স্বাভাবিকভাবেই) এনসিপি, জামায়াত এবং অন্য দলগুলো একমত হয়েছে। সেক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়, দেশটাকে নতুন করে গড়া, নতুনভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে গড়ে তোলার জন্য যে রাজনীতি, সে রাজনীতির প্রতি যে কমিটমেন্ট সেটাকেই নির্বাচনী রাজনীতিতে জোটের বা সমঝোতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রধানতম বিবেচ্য বিষয় হিসেবে এটাকে মূল্যায়ন করছি।’

এর আগে বিএনপির সঙ্গেও আসন সমঝোতার বিষয়ে এনসিপি আলোচনায় বসেছিল বলে খবরে এসেছে। তবে সেখানে কোনো সুরাহা না হওয়ায় জামায়াতের দিকে দলটি ঝুঁকছে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

‘বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনে যেটা বোঝা যাচ্ছে যে তারা ভোটের হিসাব করছেন। আসন বেশি পাওয়া যাবে জামায়াতের কাছ থেকে সেই হিসাবটা করছেন।’-বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ সাহান।

তার মতে, অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে বেশি আসনের প্রতিশ্রুতি না পাওয়া এবং জামায়াতের সঙ্গে গেলে সেই সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে। তারা মনে করছেন এর মাধ্যমে তারা পার্লামেন্টে যেতে পারবেন এবং সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারবেন।

যদিও গত ১০ ডিসেম্বর ১২৫ আসনে নিজেদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না।

তিনি বলেছিলেন, ‘সিট কয়টা পাবো কি পাবো না, সেটা বিবেচনায় রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেছি না। সিট নিশ্চিত করতে হলে আমরা কোনো না কোনো জোটের সঙ্গে চলে যেতাম।’

সমাজ বিশ্লেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, আন্দোলনের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠা দল এনসিপি, যাকে বলা হয় ‘মুভমেন্ট পার্টি’। ফলে শুরু থেকেই দলটি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ যে বয়ান উৎপাদন করেছে, তার সঙ্গে দলটির বর্তমান অবস্থানের কোনো মিল নেই। বরং দলটির বিরুদ্ধে ‘জামায়াতের বি টিম’ হওয়ার যে অভিযোগ উঠেছিল, দলটি যদি আসন সমঝোতায় যায় তাহলে সেই দাবিকেই সত্যি প্রমাণ করবে এবং ‘একটি আলাদা স্বতন্ত্র আইডেন্টি নিয়ে একটা মুভমেন্ট পার্টি হিসেবে এনসিপির বেড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল সেটাকে তারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবে বলে মনে করেন অধ্যাপক সাহান।

তবে বিষয়টিকে কিছুটা ভিন্নভাবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তার মতে, এনসিপি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলতে কী বুঝিয়েছে, সেটা কখনো স্পষ্ট করতে পারেনি এবং দলটি ক্ষমতার রাজনীতিতে ঢুকে গেছে।

‘পাওয়ার পলিটিক্সে সবই চলে আর এনসিপি যেহেতু পাওয়ার পলিটিক্সের অংশ হয়ে গেছে, সো এখানে অন্যায় কিছু নাই।’-বলেন তিনি।

এনসিপি নেতারা দল ছাড়ছেন কেন?

জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে চলমান আলোচনার মধ্যেই দলের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মীর আরশাদুল হক।

এর আগে, দলটির আরো তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা অনিক রায়, তুহিন খান এবং অলিক মৃ দলটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত হয়ে গেলেও এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে আভাস পাওয়া গেছে।

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এনসিপির কাছে নিজেদের ভোটব্যাংক তৈরির সুযোগ ছিল। কিন্তু সে পথে না গিয়ে গতানুগতিক ক্ষমতার রাজনীতির দিকেই ঝুঁকেছে দলটি।

তাদের মতে, বিভিন্ন জরিপে এনসিপির সমর্থকদের যে হার সামনে এসেছে, জামায়াতের সঙ্গে জোটে গেলে সেই সংখ্যা আরো কমে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে দলটি পুরোপুরি জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।

আর এর সঙ্গে যে অংশটি একমত নন, তারাই পদত্যাগ করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে বলে মনে করছেন অনেকে।

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদের মতে, কিছু লোক ‘নিজেদের স্বার্থ আদায় করার জন্য, নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য’ এনসিপির ফোরামটাকে ব্যবহার করছে।

বহু মত-পথের মানুষ এখানে এসে এসে জড়ো হয়েছিল; এখন যাদের মত-পথ মিলছে না তারা দল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর