শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ছাত্রদলের তোপের মুখে পড়া কে এই ডা. সাবরিনা?

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ছাত্রদলের তোপের মুখে পড়া কে এই ডা. সাবরিনা?
ডা. সাবরিনা চৌধুরী।

ডা. সাবরিনা চৌধুরী। এক সময় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ছিলেন। এই পরিচয়ে পেশাগত জীবন শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন এই কার্ডিয়াক সার্জন।

করোনাকালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে কর্মরত অবস্থায় সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে। সেই প্রতিষ্ঠানই পরে পরিচিতি পায় ‘জেকেজি হেলথ কেয়ার’ নামে। যে প্রতিষ্ঠানে সাবেক স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে মিলে করোনায় ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা অভিযোগে তাকে যেতে হয় কারাগারে। জেল থেকে মুক্তি পেলে চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে পড়েন সাবরিনা।


বিজ্ঞাপন


ব্যক্তিগত জীবনযাপনের বাইরেও মাঝেমধ্যে সামাজিক কিছু কর্মকাণ্ডেও জড়িত হতে দেখা গেছে এই চিকিৎসককে। তবে মামলার ঘানি টানতে থাকা সাবরিনা সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন তার নতুন পরিচয়। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ভাবনা থেকে বিএনপির বলয়ের দিকে লক্ষ্য ঠিক করেন তিনি।

বিএনপিপন্থি সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠন ‘জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা’ (জাসাস)-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদও পেয়েছেন।  এরপর থেকেই সক্রিয়ভাবে বিএনপির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সেই চেষ্টাই আবারও তাকে নিয়ে আসে সমালোচনার মুখে।  

সম্প্রতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েন ডা. সাবরিনা। গত ২৫ আগস্ট জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না।

sabrina-2
করোনার রিপোর্টে জালিয়াতির অভিযোগে আটক হন ডা. সাবরিনা

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘বিতর্কিত ডাক্তার সাবরিনা করোনার সার্টিফিকেট জালিয়াতি মামলায় অপরাধী। এই মহিলা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের মাজারে যাওয়ার সাহস পেল কোথা থেকে? তাকে যারা নিয়ে গেছে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’

এমন বিতর্কের মধ্যে জাসাসের নরসিংদী জেলা শাখার বেশ কয়েকজন লোকজন নিয়ে ডা. সাবরিনা শনিবার সকালে জিয়াউর রহমানের সমাধি এলাকায় যান। কিন্তু খবর পেয়ে ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের নেতা আকরাম কয়েকজন নেতাকর্মী নিয়ে সেখানে যান।

তারা জিয়াউর রহমানের মাজারে তার আসা নিয়ে প্রশ্ন করেন। এক পর্যায়ে তোপের মুখে পড়েন তিনি। ছাত্রদল নেতা আকরাম ডা. সাবরিনার পরিচয় জানতে চান।  জবাবে সাবরিনা বলেন, ‘আমি কেন্দ্রীয় কমিটির এক নম্বর সদস্য।’

এরপর ছাত্রদলের ওই নেতা বলেন, ‘বিএনপি থেকে একটি প্রেসনোট দেওয়া হয়েছে। আপনার তো এখানে আসার কথা না। আপনি আওয়ামী লীগের সময় শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্লোগান দিয়েছেন।’

জবাবে সাবরিনা বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে নিয়ে আমি কখনো কোনো স্লোগান দেইনি।’ তিনি ছাত্রদল নেতাদের কাছে স্লোগান দেওয়ার প্রমাণ চান।

একপর্যায়ে আকরাম সাবরিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।’ এতে অসম্মতি জানিয়ে সাবরিনা বলেন, জিয়ার মাজার সবার।

পরে উপস্থিত নেতাকর্মীরা সাবরিনাকে ঘিরে ‘আওয়ামী দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’ এমন স্লোগান দিতে থাকেন।

বেশ কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। তবে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা সাবরিনার চলে যাওয়ার দাবিতে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে গাড়িতে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন সাবরিনা।

করোনাকালে যেভাবে আলোচনায় আসেন সাবরিনা

করোনাভাইরাস যখন দেশে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেই মহামারিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায় একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র।  তখনই সামনে আসে ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীর নাম।

আরিফ নিজেকে জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও পরিচয় দিতেন। আর সাবরিনা ছিলেন চেয়ারম্যান। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে চুক্তি করে তারা করোনা স্যাম্পল সংগ্রহের অনুমতি নেয়। শুরুতে তিতুমীর কলেজ মাঠে বুথ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহ শুরু করলেও পরে বিভিন্ন জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

পরে অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মোট ২৭ হাজার করোনা টেস্ট রিপোর্ট সরবরাহ করে। এর মধ্যে মাত্র ১১ হাজার ৫৪০টি রিপোর্ট আইইডিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০টি রিপোর্ট ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া। গুলশানে জেকেজির অফিসে একটি ফ্ল্যাটে বসে একটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে তৈরি হতো এই মনগড়া করোনা টেস্ট রিপোর্ট। গণমাধ্যমে ফলাও করে সেই খবর প্রচারের পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

জানা গেছে, জেকেজির মাঠকর্মীরা স্যাম্পল সংগ্রহ করে আনতেন, এবং রোগীর উপসর্গভিত্তিক একটি প্রশ্নপত্র পূরণ করিয়ে আনতেন। সেই প্রশ্নপত্র দেখে শুধুমাত্র অনুমাননির্ভরভাবে রিপোর্ট তৈরি করা হতো—যার মধ্যে বেশি উপসর্গ দেখা যেত, তাকে দেওয়া হতো পজিটিভ রিপোর্ট, বাকিদের নেগেটিভ।

তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি রিপোর্টের জন্য রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো ৫ হাজার টাকা করে। বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে নেওয়া হতো ১০০ ডলার। বিনামূল্যে সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে করোনার মতো স্পর্শকাতর একটি ইস্যুকে বানিয়ে ফেলা হয় কোটি টাকার ব্যবসা।  প্রায় সাত কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নেয় জেকেজি।

sabrina-1
শনিবার জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ছাত্রদলের তোপের মুখে পড়েন ডা. সাবরিনা।

পরে করোনার রিপোর্ট নিয়ে এমন প্রতারণার অভিযোগে ২০২০ সালের ২৪ জুন জেকেজির গুলশান অফিসে অভিযান চালিয়ে আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।  আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও প্রতারণার কথা স্বীকার করে অভিযুক্তরা। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় একাধিক মামলা হয়। আদালত দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ডা. সাবরিনা, আরিফসহ আটজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেন।

ডা. সাবরিনার জীবনযাপন ও পারিবারিক পটভূমিও কম আলোচিত নয়।  জানা যায়, আরিফের এটি চতুর্থ বিয়ে। তার এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, আরেকজন লন্ডনে এবং তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেও এখনও তার পক্ষে দেনদরবার করেন।

ডা. সাবরিনার সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে নানা টানাপড়েন চললেও এক সময় স্বামীর প্রতারণার বিষয়েও তাকে জিডি করতে হয়েছে। পাশাপাশি আরিফের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় অশালীন প্রস্তাবের অভিযোগেও মামলা রয়েছে।

বিইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর