গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারোয়ার তুষারের সঙ্গে এক নারীর কথোপকথন। যেখানে ওই নারীকে এনসিপি নেতা ‘আপত্তিকর’ প্রস্তাব দিয়েছেন। অপরপ্রান্তের নারী কে ছিলেন তা নিয়ে একদিকে যেমন ধোঁয়াশা ছিল, তেমনি এনসিপিতে সক্রিয় একাধিক নারী কর্মীর নাম চলে আসে। এবার যার সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছিল; তিনি নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) নীলা ইস্রাফিল নামের এই নারী তুষারের সঙ্গে যে কথোপকথন ভাইরাল হয়েছে তা স্বীকার করে ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন। তবে তিনি জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের আগে-পরে এনসিপির কর্মসূচিতে অংশ নিলেও দলে তার কোনো পদ নেই বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
পোস্টে নিজেকে একজন যোদ্ধা দাবি করে নীলা ইস্রাফিল বলেছেন, আমি এনসিপির সদস্য হই বা না হই আমি একজন যোদ্ধা। আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে লেক্সাসে চড়তাম। ২৬ জন কাজের লোক ছিল। আরাম আয়েশের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু খারাপ প্রস্তাব পাওয়ার পর আমার শ্বশুর প্রয়াত উপদেষ্টার সুফি চেহারার আড়ালে বীভৎস তাকেও আমি ছাড় দেই নাই। আমার এথিক্সের সঙ্গে যায় না বলে আমি পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষমতাবান মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি।
তিনি লিখেছেন, আমি জানি আমি যা বলছি তা কেউ বিশ্বাস করবে না। এটা অবিশ্বাস্য। আমি জানতাম, এত সুদর্শন, এত অভিজাত, এত সম্মানিত একটা মানুষকে অসম্মান করার অপরাধে সমাজ আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু সেটা জেনেও আমি আমার প্রতি করা অবিচারের প্রতিকার চেয়ে গিয়েছি। অসংখ্য প্রলোভন দেওয়া সত্ত্বেও আপস করিনি। এর পরিণতিতে আমার নামে ১৯টি মামলা দেওয়া হয়, কোনো উকিল ওয়ান ইলেভেনের উপদেষ্টা, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের বিপক্ষে দাঁড়ায় নাই। আমার ছোট মেয়ের জন্ম হয়েছে কারাগারে, আমি এখন পর্যন্ত আমার দুই মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে ঘুমাতে পারিনি। ২০২০ সালে আমার পেটের বাচ্চাকে লাথি দিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমি তাও এখনও প্রয়াত উপদেষ্টা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, পুলিশ ও ডিবির সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি।
তিনি আরও লিখেছেন, আমার কাছ থেকে আপনারা কীভাবে আশা করেন যে, তুষারের আমার সঙ্গে এই আচরণের আমি প্রতিবাদ করব না? গণঅভ্যুত্থানে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনে রাস্তায় নামার কারণে, প্রয়াত উপদেষ্টা আমার বাচ্চা দুইটাকে রেখে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। তিনি আমাকে বলেন যে, আমার কারণে আওয়ামী লীগ বাসায় পৌঁছে যাবে। সেই সময় গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে গড়ে ওঠা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা আমার প্রতি করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। আমি সপ্রতিভ, কর্মোদ্যম ও সৃজনশীল মানুষ। ফলে আগস্টের পর থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন নেতা ও কর্মীর সঙ্গে আমার আলাপ হতো। তুষারের সঙ্গে তখনই পরিচয় এবং এনসিপির জন্মের পূর্বেই তার সঙ্গে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক আলাপ হতো।
নীলা ইস্রাফিল বলেন, বিগত ডিসেম্বরে আমার প্রাক্তন স্বামী মুয়াজ আমাকে ঢাকা ক্লাবে সবার সামনে স্টেক নাইফ দিয়ে হত্যা চেষ্টার পর শহিদুল ভাই, সারা আপা, ফজিয়া করিম আন্টি সহ বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা আমার নিরাপত্তার বিষয়ে বিচলিত হয়ে যায়। সেজন্য মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেলিন আমাকে নেপালে পাঠিয়ে দেন।
বিজ্ঞাপন
পোস্টে তিনি লিখেছেন, নেপালে যাওয়ার পর থেকে তুষার প্রায়ই ফোন করতো ও তার আলাপের ধরন পাল্টাতে থাকে। সে আমাকে বিভিন্নভাবে অ্যাপ্রোচ করতে থাকে- ‘তোমার ছবি দাও’, ‘তোমার ঠোঁট সুন্দর’, ‘তোমার স্লোগান, তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠ আমাকে আকৃষ্ট করে।’
তিনি আরও লেখেন, আমি তুষারের এই ধরনের আলাপে সব সময়ই বিব্রত বোধ করেছি এবং তাকে আমাদের সম্পর্ক সাংগঠনিক ও ফর্মাল রাখতে অনুরোধ রেখেছি। যেহেতু বাংলাদেশের নতুন রাজনীতি, এনসিপি আমার জীবনের প্রধান অবলম্বন। তাই আমি তুষারকে তার আগ্রাসী আচরণ সংযত রেখে, ফর্মালভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখি। বাংলাদেশের অসংখ্য নারীকে ক্ষমতাবান পুরুষের সঙ্গে এই ধরনের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়।
নীলা ইস্রাফিল ভাইরাল কথোপকথনের বিষয়ে বলেন, রোজার সময় একদিন তুষার আমাকে অত্যন্ত আপত্তিকর একটি কথা বলে। ইতোপূর্বে সকল আলাপের সীমা ছাড়ানো এই আলাপে আমি বিব্রত বোধ করি এবং ওকে জানাই যে আমি আর কথা বলতে চাই না। কিন্তু তুষার আমাকে আলাপের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তুষার আমাকে জানায় ডিটেকটিভ পুলিশ বা ডিবি ওর সাথে কথা বলেছে, সেই বিষয়ে সে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমি তখন উপদেষ্টা হাসান আরিফের মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি এবং তুষার আমাকে ডিবির কথা বলেছে, তাই আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি নিশ্চয়ই আইনি, ডিবি ও পুলিশ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হতে পারে এবং আমার নিরাপত্তার জন্য হুমকির কোনো বিষয় থাকতে পারে; এই বিবেচনায় আমি আলাপটি রেকর্ড করি। প্রায় দেড় ঘণ্টার আলাপে ৪৭ মিনিট আমি রেকর্ড রাখি। তুষার আমাকে জানায়, ডিবি তার কাছে নীলা ইস্রাফিল সম্পর্কে জানতে চেয়েছে এবং সে ডিবিকে জানিয়েছে যে নীলা তার গার্লফ্রেন্ড; যা নিয়ে আমি তুষারকে প্রশ্ন করি। তাছাড়া আমরা তুষারের খারাপ প্রস্তাব নিয়েও আলাপ করি।
নীলা জানান, কোরবানির দিন রাতে একটি অনুষ্ঠানে নাহিদের সঙ্গে দেখা হয় এবং নাহিদকে বিষয়টি জানাই। নাহিদ আমাকে বিষয়টি দলীয় শৃঙ্খলার দিক থেকে ডিল করতে ও মহানগরে দায়িত্বে থাকা শাহরিয়ার ও নিজামকে বিষয়টি অবগত করতে বলে। যেদিন সন্ধ্যায় শাহরিয়ার ও নিজামকে আমি জানাই, তারপরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারি যে, অডিওটি কেটে সামাজিক মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে এবং ভাইরাল হয়েছে। এরপর আমাকে নিয়ে যে মিডিয়া ট্রায়াল হয়, তাতে আমি দেখতে পেয়েছি, আমার নারী সহকর্মীরাও আমার পক্ষে দাঁড়ায় নাই।
বিইউ/এফএ

