বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫, ঢাকা

বাজেট গতানুগতিক ও অংশগ্রহণহীন: বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪ জুন ২০২৫, ০৩:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

সিনিয়র নেতাদের নিয়ে যৌথসভা ডেকেছে বিএনপি

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক বলে আখ্যা দিয়েছে বিএনপি। দলটি বলছে, নতুন বাংলাদেশে দেওয়া এই বাজেটে নতুন চিন্তার প্রতিফলন হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই একতরফাভাবে এই বাজেট পেশ করা হয়েছে। ফলে তা সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হতে পারেনি।

বুধবার (৪ জুন) বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষ থেকে এই বাজেট প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।


বিজ্ঞাপন


আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

আমীর খসরু চৌধুরী মাহমুদ বলেন, দেশে এখন যেহেতু সংসদ বা গণতান্ত্রিক কোনো সরকার নাই- আমরা আশায় ছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে এবং সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে বাজেট ঘোষণা করবে। কিন্তু সরকার তা করেনি। বাজেট ঘোষণাটা পুরোপুরি গতানুগতিক।

amir_khosru_budget

পরে বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে দলের বাজেট প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি বড় নীতিনির্ধারণী উপলক্ষ। পতিত স্বৈরাচারী সরকার অর্থনীতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রেখে গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল ন্যায্য ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা। জনগণের জীবনযাত্রার অগ্রাধিকার। একারণেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পরিকল্পনা। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গভীর তাৎপর্য বহন করে।’


বিজ্ঞাপন


‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯১ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও জুলাই অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের সংগ্রাম। বার্ষিক বাজেট গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। বাজেট রাজনৈতিক সরকারের জনগণ থেকে প্রাপ্ত ম্যান্ডেট ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করার কৌশল ও বাস্তবায়ন কাঠামোর আর্থিক প্রতিবেদন। প্রতিটি দফা যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁট করে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি কাঠামো প্রদান করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘ম্যাগনা কার্টা’ কর আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। যুক্তরাজ্যে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ কর ও ব্যয়ের উপর সংসদের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করেছিল। "প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ নয়" - এই স্লোগান আমেরিকান বিপ্লববের ভিত্তি।’

বাজেট প্রস্তাবের আগে সবার মতামত না নেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বলা হয়, ‘আমরা এক যুগান্তকারী নজির তৈরি করতে পারতাম। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সর্বক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে।আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দল সাথে আলোচনা করে নূন্যতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিতে পারত। বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও তরুণ প্রতিনিধিরাও অংশ করতে পারতেন। তাহলে বাজেট একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হতো। দেশের বিভিন্ন কণ্ঠের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠত এই বাজেট। কিন্তু সে সুযোগটি কাজে লাগানো হয়নি। বাজেট প্রণয়ন একমুখী, অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক ধারার হত না।নতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটত।’

‘বর্তমানের বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সংলাপ আরও জরুরি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ বাজেটীয় বছরে নির্বাচিত সরকার আসবে। ওয়েস্টমিনস্টার ঐতিহ্য অনুসরণকারী অনেক দেশেই "অন্তর্বর্তীকালীন শাসন সংক্রান্ত রীতিনীতি" আছে, যা বাংলাদেশে নাই। সাধারণ নির্বাচন আসন্ন হলে বা নতুন সরকারের সম্ভাবনা থাকলে বাজেট অনুমোদনের ভিন্ন পন্থা থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতি-কাঠামোর বড় ধরণের পরিবর্তন করে না। উল্লেখযোগ্য কর সমন্বয় বা নতুন, বৃহৎ আকারের আর্থিক প্রতিশ্রুতিও দেয় না।’

‘রাজনৈতিক সংলাপ হলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ব্যয় বরাদ্দে বাস্তবসম্মত পুনর্বিন্যাস হত। স্বৈরাচারী সরকারের সীমাহীন জন-বান্ধবহীন নীতি-কাঠামো উদ্ভূত দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতিজনিত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় নির্বাহের সংকট থেকে মুক্তির দিক নির্দেশনা থাকত। দারিদ্র বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যেত। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে থাকায় প্রকৃত আয় কমেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা ব্যয়ের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রায় সব খাতেই কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে সমাজে ভাঙন ধরেছে; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে। অপর্যাপ্ত, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সুরক্ষা খাতে পেনশন ও কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবে দেখানো হলেও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থেকে যাচ্ছে। আজ অবধি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো অধিকারভিত্তিক হল না।’

‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কলেজ ও স্কুলগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কর মওকুফের আওতায় আনা যেত। এতে তরুণ সমাজের শিক্ষা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হত। সামাজিক সমতা ও মেধাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সহায়ক হত। শিক্ষার দুর্বল ফলাফল ও তরুণদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণ না থাকার বিশাল হার ডেমগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক। এসব খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি সম্ভব নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়ে যাচ্ছে।’

অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতাগুলোর সমাধানে সুস্পষ্ট রূপরেখার প্রয়োজন ছিল জানিয়ে বাজেট প্রতিক্রিয়ায় আরও বলা হয়, ‘প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল - বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ-নকশা উপস্থাপন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে শিল্প কারখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল। জরুরি ছিল ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি বিভিন্ন খাতে সহায়তার মাধ্যমে আরও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির। বিশাল সুদের হারের সাথে অতিরিক্ত কর ও শুল্ক শিল্পে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে, উৎপাদনশীল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্মসংস্থানও কমতে পারে। মধ্যম ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর আর্থিক চাপ বাড়লে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিও থমকে যেতে পারে। ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমানো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস এবং ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ কমানোরও কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় উদ্যোক্তারা অনিশ্চিত ও প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হবেন।’

‘অনলাইন ব্যবসার ওপর শুল্ক বাড়ানোয় ডিজিটাল উদ্যোক্তারা চাপে পড়বেন। এই খাত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ডিজিটাল রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। তরুণ উদ্যোক্তাদের হতাশা বাড়বে। উদ্ভাবনও নিরুৎসাহিত হবে। আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতাও কাটেনি। পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ অবহেলিতই থেকে গেলেন। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নাজুক। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং করজাল সম্প্রসারণের মত পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আহরণে নতুন ভিত্তি তৈরি হত। সরকার ব্যাংক খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’ দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কর ফাঁকি প্রদানকারীদের পুরস্কৃত করছে। নিয়মিত করদাতাদের প্রতি এটি অবিচার। করব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমতে পারে। আয়কর স্লাবে কর হারের পরিবর্তন অধিকাংশ করদাতাদের উপর আরও অভিঘাত ফেলবে। কর ফাঁকি ও জালিয়াতি রোধ এবং কর জাল সম্প্রসারণ না করে ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে বরাবররের মত করের বোঝা সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে। পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। জীবনযাত্রার মান কমছে।’

আরও পড়ুন-

ক্ষমতায় গেলে ১৮০ দিনের কর্মপরিকল্পনায় কী থাকবে, জানালো বিএনপি

অপ্রয়োজনীয়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ বা সংস্কারের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই জানিয়ে দলের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ‘এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক ফলাফল পর্যালোচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে রিভিউ বা রিনেগোসিয়েট করা যেতে পারে। এতে ব্যয় কমিয়ে জনকল্যাণে বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে।’

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর