২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে তৎকালীন সরকারি দল আওয়ামী লীগের হামলার ঘটনা ঘটলে সন্ধ্যায় দলের নেতাকর্মীদের হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে সেদিন বিএনপির নেতাকর্মীরা দলীয় প্রধানের এই নির্দেশনা মানেননি। এটা দলটির ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে মনে করেন হেফাজতে ইসলামের আলোচিত নেতা এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক। সেদিন বিএনপি হেফাজতের পাশে দাঁড়ালে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করতে ২০২৪ সালের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না বলেও মনে করেন মাওলানা মামুনুল হক।
মঙ্গলবার (২৭ মে) বিএনপির কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে মাওলানা মামুনুল হক বিএনপি নেতাদের ইসলামপন্থীদের সঙ্গে কোনো ধরনের দ্বন্দ্বে না জড়ানোর পরামর্শ দেন।
বিজ্ঞাপন
আলোচনায় মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করি—এমন এক দর্শনে, যা আমাদের চিন্তা ও কর্মপন্থার মূল ভিত্তি। আমি ব্যক্তিগতভাবে যে আদর্শকে অনুসরণ করি, তাতে কোনো সংশয় নেই, কোনো দুর্বলতা নেই। দৃঢ় বিশ্বাস থেকে আমি ও আমরা আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করি। আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন একেবারে পরিপূর্ণ এবং নির্ভুল—আর সেটি হলো ইসলাম।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির বলেন, বাং‘লাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে আমাদের আদর্শগত জায়গায় ঐতিহাসিক মিল যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু মতভেদও রয়েছে। এই ঐতিহাসিক মিল মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ উপনিবেশকালীন সময় থেকে শুরু করে বঙ্গভঙ্গ ও তার বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে দুটি রাজনৈতিক ধারা জন্ম নিয়েছিল, তার একটি হচ্ছে বিএনপি। আমি মনে করি, বিএনপিকে এই ঐতিহাসিক অবস্থান সবসময় স্মরণে রাখা উচিত।’
বিজ্ঞাপন
নিজের বাবার কথা স্মরণ করে মামুনুল হক বলেন, ‘আমার আব্বাজান শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.সহ মরহুম নেতৃবৃন্দ ও বেগম খালেদা জিয়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক এবং আগামীর বাংলাদেশে তার প্রয়োজনীয়তা আরও গভীরভাবে অনুভূত হবে।’
মামুনুল হক বলেন, ‘তবে আমি বিএনপির নেতৃবৃন্দকে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ২০১৩ সালে যখন আমরা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিলাম, তখন সন্ধ্যায় বেগম জিয়া হেফাজতের নিরীহ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেদিন বিএনপি নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার নির্দেশ পালন করলে চব্বিশের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না। তের সালেই হয়ত ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়ে যেতে দেশ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, অনেকেই সে নির্দেশ পালন করেননি। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল, যা আজও আমাদের ব্যথিত করে।’
মজলিস আমির বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ছাত্রদলের নেতৃত্ব মেধার ভিত্তিতে নির্ধারিত হলে বিএনপি আগামীতেও সফলতা অর্জন করতে পারবে। ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের সচেতন তরুণেরা রাজপথে নেমে নিজেদের অধিকার আদায় করেছে—যা অনেকাংশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। এই বাস্তবতা থেকে বিএনপির শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘আমাদের পরামর্শ, আগামী দিনের রাজনীতি কেমন হবে, সেটা শুধু বিএনপির নিজেদের অবস্থান থেকে ভাবলে চলবে না। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, সেখানে বিএনপিকে সকল স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে—বিশেষ করে ‘জুলাই আন্দোলন’-এর সব পক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে।’
মামুনুল হক বলেন, ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি বিএনপির হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বিএনপির কিছু নেতার মাঝে ইসলামবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, যা আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে। আমি আশাবাদী, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নেতাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে।’
বিএনপির প্রতি প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটাই প্রত্যাশা—বিএনপি যেন ইসলামপন্থীদের সঙ্গে কখনোই দ্বন্দ্বে না জড়ায়। বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে একটি সুন্দর, ন্যায্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।’
জেবি
