ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশেনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এসব জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রশাসক। তবে নির্বাচনের পরে করা মামলায় রায়ে গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে শাহাদাত হোসেনকে, গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে আদালত।
অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাকের নামে গেজেটও হয়েছে। যদিও নির্বাচনের হিসেব অনুযায়ী আগামী ১৫ মে শেষ হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের মেয়াদ। সে হিসেবে শপথ নিয়ে দায়িত্ব শুরু করলেও এখন কতদিন মেয়র হিসেবে পদে থাকতে পারবেন ইশরাক হোসেন সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। আবার সেই মেয়রের মেয়াদকাল কতদিন হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
তবে তার শপথসহ সার্বিক বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানা গেছে। ইশরাক নিজেও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অন্যদিকে ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়া ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তার নামে গেজেট প্রকাশ এবং শপথ অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে রোববার নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান।
বিজ্ঞাপন
ইশরাক হোসেনের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, আদালতের রায় যেহেতু পক্ষে এসেছে, পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন গেজেটও প্রকাশ করেছে তাই সময় যে কয়দিন হাতে থাকুক মেয়র হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করতে চান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে শপথ অনুষ্ঠানসহ সার্বিক পরিস্থিতির দিকেও তার লোকজন নজর রাখছেন।
সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন থেকে গত রোববার (২৭ এপ্রিল) রাতে বিএনপি নেতা ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করার পর এ সংক্রান্ত ফাইল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে। রোববার মন্ত্রণালয়ের সচিবের দফতর হয়ে বর্তমানে উপদেষ্টার দফতরে আছে।
আরও পড়ুন—
জানা গেছে, সোমবার এক অনুষ্ঠানে ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী করে গেজেট প্রকাশ নিয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের আলোচনা চলছে। ইসি মন্ত্রণালয়ের মতামত না নিয়েই গেজেট প্রকাশ করেছে বলে দাবি করেছেন উপদেষ্টা। যে কারণে শপথ গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে শপথ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কবে নাগাদ আসতে পারে তা এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ নেই।
মেয়র পদে বসার বিষয়ে ইশরাক হোসেনের ঘনিষ্ঠ এক নেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, আদালতের আদেশ মেনে নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে। সেক্ষেত্রে মেয়াদ কতদিন আছে সেটা বড় বিষয় না। একদিন সময় থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই ইশরাক হোসেন মেয়র পদে বসবেন। যতটুকু জানি এটা দলেরও সিদ্ধান্ত।
যেভাবে মেয়র ইশরাক
২০২০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফজলে নূর তাপস চার লাখ ২৪ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছিলেন দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। ওই নির্বাচনে অনিয়ম কারচুপির অভিযোগও ছিল বিস্তর। তবে ভোটের এক মাসের মাথায় ওই বছরের ৩ মার্চ নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল চেয়ে মামলা করেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন।
চলতি বছরের ২৭ শে মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম ওই নির্বাচনের ফল বাতিল করে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে রায় দেন। একই সঙ্গে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসকে মেয়র হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করে সরকারের গেজেট বাতিল করেন আদালত। ২৭ মার্চ নির্বাচনি আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রেক্ষিতে গেজেট প্রকাশ করে ইসি।
এরআগে আদালতের রায়ের পর ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়ে গত ২২ এপ্রিল চিঠি দেয় ইসি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত আসার আগেই রোববার রাতে গেজেট প্রকাশ করে ইসি।
যদিও ২০২০ সালে ইশরাক হোসেন নির্বাচন ও গেজেট বাতিলের দাবিতে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে করা মামলায় শুরুতে তিনি বিজয়ী ঘোষণার জন্য আবেদন করেননি। অবশ্য গেজেট প্রকাশে কেন দেরি হচ্ছে তা জানতে গত বৃহস্পতিবার সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছিলেন ইশরাক হোসেন।
শপথ আটকাতে আইনি নোটিশ
এদিকে ইশরাকের শপথ ঠেকাতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, আইন সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনের সচিব, বিচারক মো. নুরুল ইসলাম ও বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
নোটিশে আইনজীবী মনিরুজ্জামানের বলেছেন, নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশন রায়টির বিরুদ্ধে আপিল করবে বা রিভিউ না করে দ্রুততার সঙ্গে গেজেট প্রকাশ করেছে, যা আইনগত দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।
তার দাবি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামত না নিয়েই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দিয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। কারণ, সংশ্লিষ্ট মেয়রের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে এবং মেয়রের পদ পূর্বে শূন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে এমন রায় বাস্তবায়নের কোনো মানে হয় না।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান আইন অনুযায়ী এই সিটি করপোরেশনের মেয়াদ আছে আর ১৫-১৬ দিন। সেই অনুযায়ী যদি নতুন করে তফসিল ঘোষণা করা হয়, সেখানে যদি ইশরাক হোসেন প্রার্থী হতে চান তাহলে তাকে এই সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।
যদি মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করা হয় তখন কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বর্তমান আইনে এই বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নাই। তবে স্থানীয় সরকার কমিশন নতুন যে সংস্কার প্রস্তাব করেছে সেখানে মেয়াদ শেষে ভোট না হলে প্রশাসক বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।’
তবে এমন পরিস্থিতি এরআগে না ঘটায় শপথ নিলে ইশরাক হোসেন কতদিন পদে থাকতে পারবেন তা নিয়ে আইনগত জটিলতা রয়েই গেছে বলেও মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।
বিইউ/ইএ
