সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিএনপিসহ কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। যদিও প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে বলে আভাস দিচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশনও ডিসেম্বরেই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে। মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, সরকার প্রধান যেখানে একটি টাইম ফ্রেম ঘোষণা করেছেন, ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারির শুরু দিকে, আমরা ডিসেম্বর ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত মাস ডিসেম্বর হলেও নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির বক্তব্য আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
বিজ্ঞাপন
‘বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে না নেওয়া অবধি কেউ যেন ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে’ অথবা ‘চলতি বছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হলে গণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে করা যেতে পারে’- বলে নতুন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ঘিরে চলছে আলোচনা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কিংবা যকোনো ফৌজদারি মামলার বিচার দীর্ঘ প্রক্রিয়া হওয়ায় ডিসেম্বরের আগে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে তবে কি শেখ হাসিনার বিচারের আগে নির্বাচন নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলটির আপত্তি রয়েছে? ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণপরিষদ নির্বাচন দাবি করা এই দলটি নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে?
বিজ্ঞাপন
হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে পরে নির্বাচন
জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম মঙ্গলবার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও কবর জিয়ারত করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘এই বিচার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে করতে হবে। যেই সময়টুকু এই সরকারের আছে নির্বাচনের আগেই খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে। যতদিন না আমরা খুনি হাসিনাকে ওই ফাঁসির মঞ্চে না দেখছি এই বাংলাদেশে কেউ যেন ভুলক্রমেও ওই নির্বাচনের কথা না বলে।’ সারজিস আলম বিবিসি বাংলাকে তার এ বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বিচারের প্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করাই এ কথার উদ্দেশ্য।
সারজিস আলম বলেন, ‘ব্যাপারটা এরকম নয় যতক্ষণ না বিচার হচ্ছে ততক্ষণ নির্বাচন নয়। ব্যাপারটা বরং এরকম এই কথার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয় ও সর্বোপরি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর প্রত্যক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করা যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই হত্যাযজ্ঞের সাথে সম্পর্কিত যারা প্রধান আসামি ও নির্দেশদাতা তাদের বিচার নিশ্চিত ও প্রক্রিয়া আরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যায়।’ যদিও নির্বাচনের আগেই অন্তত শেখ হাসিনার বিচার নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির এই নেতা বলেন, ‘শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেখ হাসিনা গণহত্যা চালাল, নৃশংসতা চালাল, হাজারের ওপর মানুষের প্রাণ নিল অন্তত সেই একটা মানুষের বিচারটা যেন নির্বাচনের আগে নিশ্চিত করা যায়। কারণ সাধারণ ৫০ জন মানুষের বিচার হওয়ার চেয়ে একজন খুনি শেখ হাসিনার বিচার হওয়াটা অনেক বেশি ইমপ্যাক্টফুল (কার্যকর)। আমাদের কাছে অনেক বেশি কার্যকরী।’
ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে দলটি?
এখন পর্যন্ত ডিসেম্বরকে ঘিরেই সরকারের নির্বাচন প্রস্তুতি দৃশ্যমান। ফলে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নিয়ে গঠিত নতুন এই রাজনৈতিক দলটির নির্বাচনকে ঘিরে নানা ধরনের বক্তব্য এক ধরনের সংশয় তৈরি করছে।
এই দলের নেতারা বলছেন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্ব শর্ত পূরণ করে তবেই অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যে সময়টাকে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত মনে করবে সেখানে জোরালোভাবে দ্বিমত করবে না তারা।
দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘কিন্তু তার পূর্বে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার যে পূর্বশর্ত রয়েছে যেমন বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মতো আস্থা অর্জন করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্বগুলো পালন করার মতো অবস্থা হওয়া কিংবা নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ নির্বাচন দিতে পারবে এরকম আস্থা অর্জনের কোয়ালিটি নিশ্চিত করা এই বিষয়গুলো যখন হয়ে যাবে তখন অন্তর্বর্তী সরকার মনে করলে নির্বাচন দিতে পারবে।’
দলটির নেতারা মনে করছেন প্রয়োজনীয় সংস্কার না করে নির্বাচন আয়োজন করলে তা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তার সাথে প্রতারণা করা হবে।
সারজিস আলম বলেন, ‘যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে এই সিস্টেমগুলো সংস্কার করে সেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারে তাহলে তো সেখানে আমরা দ্বিমত জানাব না। কিন্তু দিন শেষে আমাদের একমাত্র প্রায়োরিটি যদি শুধুমাত্র নির্বাচন হয় তবে অভ্যুত্থান পরবর্তী মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা এটার সাথে একটা প্রতারণা করা হবে।’
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বরাবরই আগে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে। এমনকি রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই যেকোনো সংস্কার করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
এই বিষয়টি উল্লেখ করলে সারজিস আলম জানান, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সংস্কারের বাস্তবতা অধরাই থেকে যায়। কারণ সেখানে জনগণের এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে কোনো ব্যক্তির বা দলের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পেয়ে যায়।
বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো নির্দিষ্ট দলের না হওয়াতে দেশের মানুষের স্বার্থে এই সংস্কারগুলো যুগোপোযোগীভাবে করতে পারে বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির এই নেতা।
ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা সম্ভব বলে মনে করেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি উদার মনোভাব দেখিয়ে সহযোগিতা করে তাহলে ডিসেম্বর কিংবা তার কাছাকাছি সময়ে এই প্রয়োজনীয় সংস্কার করা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের আরও সুদৃঢ় অবস্থান লাগবে। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, আমলাতন্ত্র, অন্তর্বর্তী সরকার সকলের যৌথ প্রচেষ্টা লাগবে।’
তবে দলটির নেতারা মনে করছেন সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের যে সুদৃঢ় অবস্থান, গতি বা প্রচেষ্টা থাকা দরকার এখন পর্যন্ত সেটি নেই। যদি ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেক্ষেত্রে দলটি অংশ নিতে পারবে বলেও জানান সারজিস।
জাতীয় নাগরিক পার্টির এই নেতা বলেন, ‘যেভাবে একটি রাজনৈতিক দল যে সকল শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষে নিবন্ধন নেয়া ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিয়ে থাকে আমরা আমাদের সেই প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করবো এবং আমরা আমাদের জায়গা থেকে বিশ্বাস করি নির্বাচনের পূর্বেই আমরা প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে আমাদের দলের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারব।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এমআর