বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী জোট কতদূর

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৮ এএম

শেয়ার করুন:

ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী জোট কতদূর

চরমোনাই পীর হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঙ্গে বরিশালে গিয়ে দেখা করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তাদের ‘সৌজন্য সাক্ষাতে’র পর ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নির্বাচনী জোটের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। এসব দলের নেতারা মনে করেন জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামপন্থী দলের নিজস্ব একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে, যারা পরিস্থিতি অনুযায়ী কিছুটা প্রভাবও তৈরি করতে পারে। সেটিই তাদের ‘ভোটের জোটে’ উদ্বুদ্ধ করেছে বলে ধারণা করা হয়।

সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, তারা চাইছেন আগামী নির্বাচনে ‘ইসলামভিত্তিক দলগুলোর যেন একটি বাক্স থাকে। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য ভুলে আমরা চাইছি আমাদের ভোট যেন সামনে আর ভাগাভাগি না হয়।’


বিজ্ঞাপন


জামায়াতে ইসলামীও বলছে দলগুলোর মধ্যে আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেই এর একটি রূপ দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ।

ঐক্য ও নির্বাচনী জোট বিষয়ক আলোচনায় আছে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামভুক্ত নেতাদের কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নেজামে ইসলাম পার্টির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদীও জানিয়েছেন যে ‘ইসলামি দলগুলোর ঐক্য প্রক্রিয়া অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ এই আভাষই দিয়েছে যে তাদের মধ্যে দূরত্ব কমছে।


বিজ্ঞাপন


‘মনে হচ্ছে তারা একটি নির্বাচনী ঐক্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত তারা সেটি পারেন কি না।

ঐক্য প্রক্রিয়ার সূচনা কারাগার থেকে?

বাংলাদেশে ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আবার প্রকাশ্যে চলে আসে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল। বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেদিনই সেনাপ্রধান যাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান এবং খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হক।

শফিকুর রহমান এবং মামুনুল হকের মতোই নেজামে ইসলাম পার্টির একজন নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদীও শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিভিন্ন মামলায় কারাগারে ছিলেন। তার দাবি একসময় নানা বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও কারাগারে থাকার সময়ই এসব আলাদা আলাদা দল করা কিন্তু ইসলামি আদর্শে বিশ্বাস করেন, এমন নেতাদের মধ্যে হৃদ্যতা বেড়েছে এবং কথাবার্তার সুযোগ হয়েছে।

‘আমি মনে করি এখন যে ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ চলছে তার সূচনা হয়েছে কারাগারেই। তখন ইসলামপন্থী অনেকে কারাগারে ছিলেন। ফলে ৫ আগস্টের পর ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করা সহজ হয়েছে।’-বলেন আজিজুল হক ইসলামাবাদী।

তবে ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের বিভিন্ন ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতবিরোধ ছিলো প্রকট। শেখ হাসিনা সরকারের শেষ দিকে এসে ইসলামী আন্দোলন সরকার বিরোধী অবস্থান নিলেও তার আগে দীর্ঘদিন ধরে তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়েই আসছিল।

তবে ইসলামী আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব আহমদ আবদুল কাইয়ুম তাদের দল সম্পর্কে এমন ধারনার কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

‘আমরা কখনো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করিনি। আমরা কোন জোটে না ভিড়ে নিজেদের মতো করে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি।’

ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলছেন, জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অনেকগুলো ইসলামভিত্তিক দলের সঙ্গেই তারা এখন আলোচনা করছেন, কারণ তারা চান তাদের ভোট ‘এক বাক্সেই’ থাকুক।

‘খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ও নেজামে ইসলামসহ অনেকগুলো দলের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে দূরত্ব বা মতপার্থক্য আছে এটি সত্যি। কিন্তু আশা করি আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্বাচনী জোট বা সমঝোতায় আমরা উপনীত হতে পারব।’-বলেন তিনি।

জোটের কারণ আদর্শ নাকি অন্য কিছু?

একাধিক ইসলামভিত্তিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে এমনও একটি ধারণা পাওয়া গেছে যে তাদের মধ্যে ঐক্যের উদ্যোগটি এসেছে জামায়াতে ইসলামীর দিক থেকে।

জামায়াতে ইসলামী দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র হলেও এখন তাদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে ‘হৃদ্যতার সংকট’ প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষ করে শেখ হাসিনার পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দাবি করলেও জামায়াতের অবস্থান ছিলো ভিন্ন, যা বিএনপি নেতাদের ক্ষুব্ধ করেছে। এর জের ধরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

দলের একজন নেতা ৫ আগস্টের পর ইসলামী ব্যাংক দখলের জন্যও জামায়াতকে ইঙ্গিত করে নানা মন্তব্য করেন। এর দুইদিন আগে ২৭ ডিসেম্বর দলটির কর্মী সম্মেলনে ‘একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

এমন পরিস্থিতিতে গত সেপ্টেম্বর থেকে ইসলামভিত্তিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল জামায়াতে ইসলামী। ইসলামি দলগুলোকে এক জায়গায় এনে ভোটের রাজনীতিতে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করার চিন্তা থেকেই তাদের মধ্যে জামায়াত ঐক্যের উদ্যোগ নিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন।

‘একদিকে আওয়ামী লীগ মাঠে নেই, অন্যদিকে বিএনপির নির্বাচনী বলয়ে জামায়াত নেই। আবার এককভাবে খুব বেশি জায়গায় ভোটে জেতার সামর্থ্য জামায়াতের নেই। আমার মনে হয় এ পরিস্থিতিই নানা ইস্যুতে বিভক্ত থাকা ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিয়ে জোট করে ভোটে যাওয়াতে আগ্রহী করে তুলেছে জামায়াতকে। সে কারণেই তারা হয়তো ঐক্যের চেষ্টা করছে।’ বলেন তিনি।

তবে জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, বরিশালে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সাক্ষাৎ নিতান্তই সৌজন্যমূলক। তবে আলোচনা, মতবিনিময় ও কথাবার্তা চলছে। নির্বাচনের আগেই হয়তো অনেকদূর অগ্রসর হবে বিষয়টি।’

অবশ্য নির্বাচন কবে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা এখনো নেই। যদিও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন চলতি বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে তারা এ সময়সীমা ধরেই কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন।

যদিও বিএনপি মনে করছেন সরকারের চলমান সংস্কার কাজের পাশাপাশি জুন-জুলাইয়ের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। কিন্তু এর মধ্যেই সরকারের ঘনিষ্ঠ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের সমর্থিত নাগরিক কমিটি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকের ধারণা শেষ পর্যন্ত ছাত্ররা দল করতে সক্ষম হলেও এককভাবে নির্বাচন করা তাদের জন্য কঠিন হতে পারে।

সেক্ষেত্রে বিএনপি তাদের সঙ্গে জোট করতে আগ্রহী না হলে জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামি দলগুলোর যে জোট হবে তার সঙ্গে ছাত্রদের সম্ভাব্য দলের নির্বাচনি ঐক্য হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হতে পারে।

চরমোনাই পীর হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলছেন, প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলেই তারা এখন আশা করছেন সামনের নির্বাচনে মানুষ ইসলামভিত্তিক দলগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।

‘এ কারণেই আমরা এক জায়গায় আসতে চাইছি। ইস্যুভিত্তিক পার্থক্য আছে ও থাকবে। কিন্তু নির্বাচন বড় জায়গা সেখানে যাতে আমাদের একটিই বাক্স থাকে সেজন্যই এখন কাজ চলছে। আশা করি আমরা সফল হতে পারব।-বলেন রেজাউল করিম। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর