শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

বিতর্কের কেন্দ্রে সভাপতি, অন্তর্কোন্দলের আগুনে পুড়ছে অষ্টগ্রাম বিএনপি

মশিউর কায়েস, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

বিতর্কের কেন্দ্রে সভাপতি, অন্তর্কোন্দলের আগুনে পুড়ছে অষ্টগ্রাম বিএনপি
বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছেন অষ্টগ্রাম বিএনপির সভাপতি। ছবি: সংগৃহীত

ছবির মতো সুন্দর, সুস্বাদু পনিরের খ্যাতিতে হাওরের আলোচিত উপজেলা অষ্টগ্রাম। সবুজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বুনো বাতাসের শীতল স্রোত। কিন্তু প্রকৃতির এই শান্তির ভেতর এক দমবন্ধ করা অস্থিরতা। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় অভিযোগের গুঞ্জন। সেই অভিযোগ এক মানুষকে ঘিরে—সৈয়দ সাঈদ আহমেদ। যিনি দীর্ঘ সময় ধরে পালন করে আসছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতির গুরুদায়িত্ব। কিছু দলীয় নেতাকর্মীর কাছে তার নাম উচ্চারিত হয় ভয় কিংবা বিতর্কের সুরে। আবার কেউ তার নাম নেন দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা হিসেবে গরবে। বলছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। আর এইসব অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের মাঝে ধুঁকছে অষ্টগ্রাম বিএনপি।

ঢাকা মেইল এই রহস্যময় গল্পের সত্য উদঘাটনে হাজির হয় অষ্টগ্রামে। অভিযোগের পেছনে সত্য কতটুকু, আর ষড়যন্ত্রের শিকড় কত গভীর—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু হয় অনুসন্ধান।


বিজ্ঞাপন


হাওর অঞ্চল যেন প্রকৃতির নিজ হাতে আঁকা এক নৈসর্গিক ছবি। সকালে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেইল প্রতিনিধি হাজির হন অষ্টগ্রামে। এখানকার মানুষ এখন বোরো ধান রোপণে ব্যস্ত। সারা দিন-রাত কাজ করেও ক্লান্তিহীন মুখে আশা জাগে সোনালি ফসলের। কিন্তু এই নৈসর্গিক অঞ্চলের বুক চিরে এখন বইছে রাজনীতির কালো হাওয়া।

স্থানীয় মানুষ কিংবা নেতাকর্মী, যারা একসময় বিএনপির জন্য গলা ফাটিয়েছেন, আজ তারা নীরব। চোখে-মুখে আতঙ্ক। আবার দলীয় অন্তর্কোন্দল আর সভাপতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে অনেকের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। তাদের ভাষ্য, তবে কি দলের জন্য দীর্ঘসময়ের ত্যাগেই কাল হলো সাঈদ আহমেদের।

সৈয়দ সাঈদ আহমেদ। বিএনপির দীর্ঘদিনের নেতা। একসময় যিনি দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত ছিলেন। তবে অভিযোগ ওঠেছে, সরকারের পালাবদলে গত ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি জল মহল দখল, অবৈধভাবে নদী থেকে ড্রেজারে বালু উত্তোলন, দলীয় পদ ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, সাধারণ মানুষের ওপর এমনকি নিজের দলের নেতাকর্মীর ওপরই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন।

পাওয়া গেল কয়েকজন অভিযোগকারীকে, যারা ঢাকা মেইলের টিমের সামনে মুখ খুললেন।


বিজ্ঞাপন


পূর্ব অষ্টগ্রামের জমাদার বাড়ি এলাকার উজ্জলা বিবি অশ্রুসিক্ত নয়নে জানালেন তার গল্প। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী আর দুই ছেলেকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমাদের পরিবার এখন বাড়িছাড়া। অথচ আমরা সবাই বিএনপির কর্মী ছিলাম। বড় ছেলে করত ছাত্রদল। এখন কী করব বুঝতে পারি না।’

কৃষক হামিদ মিয়া বলেন, ‘আমি বীরবল্লীতে মন্ত্রণালয় থেকে একটি ফিশারির প্রকল্প লিজ আনি। কয়েক দিন পর ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মী আমার এখানে এসে বলে- আমাদের সাঈদ ভাই পাঠাইছে। পরে ফিশারি থেকে কিছু মাছ তুলে নিয়ে যায় এবং তার কিছুদিন পর তাকে দুই লক্ষ টাকা দিতে হয়।’

ঢাকা মেইল আরও খুঁজে পায় পূর্ব অষ্ট গ্রামের ২নং ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিনকে। তিনি বলেন, ‘আমি একটি পুকুর লিজ নিয়েছিলাম। সাঈদ ভাই এসে বললেন, এক লাখ টাকা দিতে হবে। পুলাপানের খরচ, টাকা না দিলে তিনি মামলায় আমার নাম দিয়ে দিলেন। তখন আমি সাঈদ ভাইকে বললাম, ১৬ বছর আওয়ামী লীগ আমাকে মামলা দিল, বিএনপি করি বলে পুলিশের ভয়ে কুয়াশায় ঘুমাইতাম আর এখন আওয়ামী লীগ গেল আপনি মামলা দিয়ে দিলেন। তো আমরা এই দেশ ছেড়ে যাব কোথায়?’

রাজনৈতিক কারণে দলীয় গ্রুপিং একই সাথে একটি চক্র বিএনপির নাম ব্যবহার করে আবারও আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে বলে দাবি সাঈদ আহমেদ ও তার অনুসারীদের।

তাদের কথা শুনতে ঢাকা মেইল এবার তার অনুসারীদের কাছে, এলেন একাধিক নেতাকর্মী। প্রথমেই প্রশ্ন ছোড়া হলো- উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক তিতুমীর হোসেন সোহেলের কাছে। অভিযোগ রয়েছে, তার ছাত্রদলের কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাহিনী। অভিযোগ অস্বীকার করে স্পষ্ট জানালেন, ছাত্রদল চাঁদাবাজির রাজনীতি করে না। এ সময় তিনি দাবি করেন, হাওরের তিনটি উপজেলা আওয়ামী লীগের আতুরঘর ছিল। যারা এরকম প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য কেবল এই হাওরে পুনরায় আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা। 

অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ইয়াকুব ঢাকা মেইল বলেন, ‘আমাদের দলের অনেকেই  ভাবে নাই আদৌ বিএনপি এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সামনে আসবে। তারা দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে আব্দুল হামিদের সকল সুযোগ সুবিধা নিয়েছে। এখন যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে তখন বিএনপিতে অনুপ্রবেশের জন্য আর আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এমন ষড়যন্ত্রমূলক কাজকর্ম করছে।’ এ সময় তিনি দাবি করেন, ‘এসব কোন্দল কখনোই ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে না।’

স্থানীয়রা বলছেন, অষ্টগ্রামে বিএনপির এই ইমেজ সংকটের মূল কারণ হলো দলীয় অন্তর্কোন্দল। দলের ভেতরেই গ্রুপিং তৈরি হয়েছে। এক পক্ষ সভাপতির বিরুদ্ধে, অন্য পক্ষ তার পক্ষে। অনেকেই মনে করছেন, দ্রুত সমাধান না হলে সাধারণ মানুষ দলের ওপর আস্থা হারাবে।

BNP2
অষ্টগ্রাম হাওরে একদিকে চলছে ফসল রোপণ অন্যদিকে উত্তাপ ছড়াচ্ছে রাজনীতি। ছবি: ঢাকা মেইল

কিছুদূর এগোতেই দেখা মিলল বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি গিয়াস উদ্দিন আশরাফীর, টং দোকানে বসে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন রাজনীতির খবরে। জানতে চাওয়া হলো দলীয় কোন্দলের ব্যাপারে। জানালেন- ‘কিছু নেতাকর্মীর আচরণ জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হয়, প্রভাব পড়তে পারে ভোটের মাঠেও।’ বয়স্ক এই নেতা জানান- ‘বিএনপির তিন উপজেলার নেতা ফজলুর রহমান ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের কাছে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সুরাহা হয়নি।’ 

পাশেই বসা ছিলেন অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ জমির উদ্দিন। তিনিও মুখ খোলেন ঢাকা মেইলের কাছে। বলেন- ‘৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের সভাপতি সাঈদ আহমদ সাব একটা আতঙ্কের নাম হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিএনপিসহ এখন তিনি আমাদের কাছে আতঙ্কের কারণ। আমাদের যে ভাবমূর্তি ছিল বিএনপির, তা এখন হুমকির মুখে।’   

তবে এসব অভিযোগ কিংবা বিতর্কের বিষয়ে কী বলছেন সৈয়দ সাঈদ আহমেদ? তার সাথে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, জরুরি কাজে তিনি ঢাকায় আছেন। তবে এই সমস্ত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি তার। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমি দলের জন্য কাজ করেছি। এগুলো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। কেউ ইচ্ছা করে আমাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। নদীর পাড়ে যাইনি, ড্রেজার চালানোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

তাহলে গল্প কি এখানেই শেষ? না, জানতে হবে জেলার নেতারা কী বলছেন।

মাযহারুল ইসলাম, দীর্ঘদিন পালন করছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। তার ভাষ্যমতে, ‘সাঈদ আহমেদ দলের পরীক্ষিত নেতা। তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এসেছে, যেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে একটা মহল ইচ্ছাকৃতভাবে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাকে সতর্ক করা হয়েছে, কিন্তু তার নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য।’

ঢাকা মেইলের অনুসন্ধান দল যখন অষ্টগ্রামের হাওরে ঘুরে বেড়ায়, তখন চোখে পড়ে প্রকৃতির নিঃশব্দ সৌন্দর্য। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক রাজনৈতিক অশান্তি। দলের নেতাদের অনৈক্য আর সভাপতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কেবল দলের ইমেজ নয়, এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনেও ফেলছে গভীর প্রভাব।

হাওরের বাতাসে এখন রাজনীতির গন্ধ। ফসলের মাঠের নরম মাটিতে পা রাখলে অনুভব হয় মানুষের বঞ্চনার আর্তনাদ। রাজনীতির উত্তাপ যেখানে হাওর এলাকায় পৌঁছেছে, সেখানে কীভাবে গড়ে উঠবে ঐক্যের সেতু? বিএনপির এই অন্তর্কোন্দলের কি অবসান ঘটবে নাকি হাওরের ধানখেতের মতো এই সংকটও চাপা পড়ে যাবে কুয়াশার চাদরে?

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর