সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে মারা যাওয়ার পর দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে আগলে রেখেই দিন কাটে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে এসে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালিয়েছেন তিনি। তবে আলোচিত এক এগারোর সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে মহাবিপদের মধ্যে পড়ে জিয়া পরিবার। দুই ছেলের একজন বিদেশে থাকতেই মারা যান। বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০৭ সাল থেকে পরিবারসহ চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন লন্ডনে। লম্বা বিরতির পর ২০১৭ সালে একবার মা-ছেলের সঙ্গে দেখা হলেও গত সাড়ে সাত বছর কেটেছে ভার্চুয়াল কথাবার্তার মধ্য দিয়ে। এবার চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া।
সবকিছু ঠিক থাকলে মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) রাতে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ৮ জানুয়ারি, বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশটিতে পৌঁছার পর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাকে বরণ করে নেবেন তারেক রহমান।
বিজ্ঞাপন
রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও আলোচনায় দীর্ঘ সময় পর জিয়া পরিবারের আসন্ন পুনর্মিলনীর কথা। ইতোমধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকে জিয়া পরিবারের জীবিত সদস্যদের গ্রুপ ছবি আবেগঘন ক্যাপশন দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করছেন। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ কল্পনার রাজ্যে ছবি আঁকছেন কেমন হতে পারে পুরো পরিবারের মিলনমেলা।
সোমবার (৭ জানুয়ারি) রাতে তাদের পরিবারিক এই পুনর্মিলনের প্রসঙ্গ টেনে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মুখপাত্র মাহী বি চৌধুরী লিখেছেন, ‘কিছু সময়ের মধ্যেই একটি মায়ের সঙ্গে তার সন্তানের পুনর্মিলন, একজন দয়ালু দাদীর সঙ্গে তার আদরের নাতনি ও পুত্রবধূর পুনর্মিলন ঘটতে যাচ্ছে। আমি কল্পনা করে আনন্দিত হই, তাদের প্রথম পারিবারিক নৈশভোজ, যেখানে হাসি-আনন্দ, গল্প আর স্মৃতিচারণায় মুখরিত হবে তাদের পরিবেশ। অতীতের সকল রাজনৈতিক পার্থক্য ও ভুল বোঝাবুঝি সত্ত্বেও, এই পুনর্মিলনের আনন্দে আমার হৃদয় এক অনির্বচনীয় শান্তি ও তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে।’
লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে আগে থেকেই অবস্থান করছেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান। খালেদা জিয়ার সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে তার ছোট ছেলে কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথিও লন্ডন যাবেন। কোকোর দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমানও লন্ডনে আছেন। তাই লন্ডনে পুরো জিয়া পরিবারের সবাইকে এক ফ্রেমে দেখা যাবে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎকালে সুস্থভাবে যেন দেশে ফিরে আসতে পারেন সেজন্য দোয়া চেয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে চোখ ও পায়ের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন খালেদা জিয়া। দুবাইয়ে যাত্রাবিরতি শেষে ১৬ জুলাই তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সে সময় বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। লন্ডনে সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়ই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারেক রহমান তখন নিজের গাড়িতে করে মা খালেদা জিয়াকে গন্তব্যে নিয়ে যান।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারা যাচ্ছেন লন্ডনে
খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিবারের সদস্য ছাড়া চিকিৎসক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সফরসঙ্গী হবেন মোট ১৬ জন। যাত্রাপাথে কাতারে এক ঘণ্টার বিরতি থাকবে।
বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. জাহিদ জানান, আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের রাজকীয় কাতারের চারজন চিকিৎসক এবং প্যারা মেডিকসরা থাকবেন। ঢাকা থেকে খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল বোর্ডের ছয়জন সদস্য এই বিমানে যাবেন। তারা হলেন অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিক, অধ্যাপক নূরুদ্দিন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ডা. মোহাম্মদ আল মামুন।
এছাড়া খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ছোট ছেলের স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল ও খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তারসহ ব্যক্তিগত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী।
দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, লিভার, ফুসফুস, কিডনি, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এসবের মধ্যে লিভার, কিডনি ও হৃদরোগকে সবচেয়ে ঝুঁকির কারণ মনে করেন তার চিকিৎসকরা।
যেভাবে মিলল বিদেশ যাওয়ার সুযোগ
নানা রোগে আক্রান্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাজা। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে কারাগারে যেতে হয় খালেদা জিয়াকে। তার শারীরিক অসুস্থতা ও বয়স বিবেচনায় বারবার জামিনের জন্য চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। মাঝে অসুস্থতা বাড়লে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে দেয়া হয় চিকিৎসা। দুই বছর পর করোনার সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে কারামুক্তি দিলেও শর্তজুড়ে দেয় তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না।
নির্বাহী আদেশে মুক্তির পর খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে ফেরেন হুইল চেয়ারে। তখন থেকেই আবাসস্থল ফিরোজা এবং হাসপাতাল এভারকেয়ারে চিকিৎসা নিতেই সময় কাটে তার। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে ছয়বার আবেদন করা হয় বিদেশ চিকিৎসার জন্য। দলীয়ভাবে কর্মসূচিরও আয়োজন করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।
এক পর্যায়ে গুরুতর অবস্থা হলে বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে, পোর্টো সিস্টেমেটিক অ্যানেসটোমেসির মাধ্যমে তার লিভারের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওই সময়ও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা জার্মানির হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তির সুপারিশ করেছিল মেডিকেল বোর্ড।
৫ আগস্ট গণঅভুত্থানের পর মুক্ত হন খালেদা জিয়া। আইনি প্রক্রিয়ায় তার সাজা বাতিল করেন আদালত। তখন থেকেই কথা হচ্ছিল, এখন আর কেন দেরি করা হচ্ছে বিদেশে চিকিৎসার জন্য। জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য তার শারীরিক অবস্থাসহ নানা প্রস্তুতি নিতে লেগেছে।
কোন হাসপাতালে হবে চিকিৎসা
খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়াকে লন্ডন বিমানবন্দরে রিসিভ করতে আসবেন বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী এবং লন্ডন বিএনপির নেতারা। বিমানবন্দর থেকে খালেদা জিয়াকে সরাসরি লন্ডন ক্লিনিক হাসপাতালে নেওয়া হবে। সেখানে তার চিকিৎসা চলবে।
জানা গেছে, লন্ডনে কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর খালেদা জিয়াকে নেয়া হবে যুক্তরাষ্ট্রে। মেরিল্যান্ডের পূর্ব বাল্টিমোরে অবস্থিত জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার কথা শোনা গেছে।
শারীরিক সুস্থতার ওপর নির্ভর করে খালেদা জিয়া বিদেশে থাকাবস্থায় পবিত্র ওমরাহ পালনে সৌদি আরব যেতে পারেন এমন গুঞ্জনও আছে। এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহিদ বলেন, ‘মানুষ চাইলেই কিন্তু ওমরাহ করা যায় না। আল্লাহ চাইতে হয়। কাজেই রাব্বুল আলামিন যদি কবুল করেন যাবেন। এটা কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত না যে এটা করবেনই। উনি একজন ধার্মিক মানুষ। মনের ইচ্ছা আছে। উনি সুযোগ পেলে হজ করেছেন, ওমরাহ করেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ কয়েকবার। এত নির্যাতন-অত্যাচার, কষ্টের পরে শুকরিয়া আদায় করার জন্য ডেফিনেটলি উনার ওমরাহ পালনের আগ্রহ আছে।’
বিইউ/জেবি