সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরু থেকেই এর বিরুদ্ধে মারমুখী ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। সরাসরি গুলি, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলে পড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের চেষ্টাই তারা করেছে আন্দোলন দমাতে। তবে এই চেষ্টা হিতে বিপরীত হয়েছে। এর ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়েছে এবং সেই আন্দোলনের জেরেই শেষ পর্যন্ত টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয় আওয়ামী লীগের।
রাজধানী ঢাকায় আন্দোলন দমাতে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। ঢাকার দুই সিটির সিংহভাগ কাউন্সিলরই ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়। তাদের মেয়াদও প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। আন্দোলন ঠেকাতে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে না পারলে আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়া যাবে না এমন আশঙ্কা ছিল তাদের। এজন্য নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে চেয়েছিলেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা। ফলে অমানবিক আচরণ করেন তারা। কেউ কেউ অস্ত্র হাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে কাউন্সিলর পদ ১২৯টি। তাদের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের পর আত্মগোপনে চলে যান ১১৮ জন। যারা সবাই আওয়ামী লীগপন্থী।
তথ্যসূত্র বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সাধারণ কাউন্সিলের পদ ৫৪টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর ৫১ জন। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে সাধারণ কাউন্সিলের পদ ৭৫টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর ৬৭ জন। বাকিরা অন্য দলের এবং নির্দলীয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে কাউন্সিলরদের নির্মমতার বিভিন্ন চিত্র গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন।
সরকার পতনের পর আত্মগোপনে যাওয়া কাউন্সিলরদের অনেকেই বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়েছেন। সরাসরি ‘ক্লিলিং মিশনে’ অংশ নেওয়া কাউন্সিলরদের বেশির ভাগই দেশ ছেড়েছেন।
বিজ্ঞাপন
ধরা পড়াদের মধ্যে রাজধানীর মুগদা এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি হামলার নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর বি এম সিরাজুল ইসলাম বাট্রি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে গ্রেফতার করে যৌথ বাহিনী। তার বিরুদ্ধে মুগদা থানায় দুটি হত্যা মামলা রয়েছে।
১০ নভেম্বর গ্রেফতার হয়েছেন দক্ষিণ সিটির আরেক কাউন্সিলর মো. রুহুল আমিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মো. মাসুদ হত্যাসহ নয় মামলার এজাহারনামীয় আসামি তিনি। রুহুল আমিন দক্ষিণ সিটির কদমতলী এলাকার ৫২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।
আন্দোলনের সময়কালের ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে অনেকের পরিচয় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আন্দোলনকারীদের ওপর পিস্তলের গুলি ছুড়তে দেখা যায় এক ব্যক্তিকে। পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সামনের এ ঘটনা।
শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি বর্ষণকারী ওই ব্যক্তি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফ হোসেন ছোটন। জানা গেছে, তিনিই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে আন্দোলন দমনে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার অভিযোগ আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদের বিরুদ্ধে। উত্তর সিটির ২৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলুও ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন ছাত্র-জনতা হত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা। ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলামের ডান হাত হিসেবে পরিচিত হোসেন শতাধিক দলীয় ক্যাডার ব্যবহার করেছেন ছাত্র-জনতা হত্যায়।
কাউন্সিলর ছাড়াও সাবেক কাউন্সিলররাও একই হারে চড়াও হয়েছিলেন ছাত্র-জনতার ওপর। কাউন্সিলর পদ বাগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশে নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণে অস্ত্র হাতে মাঠে দেখা গেছে অনেককে।
রাজধানীর উত্তরায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ, তার ছেলে লিয়ন খান ও ভাই মো. মিঠুকে। তবে তাদের কাউকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলার বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করেন এলাকাবাসী। এর মধ্যে গত ২ আগস্ট উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টরের কিছু ছবিতে যুবরাজ, তার সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের দেখা যায়।
ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্র-জনতার উপর চড়াও হওয়া প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। সাবেক, বর্তমান কাউন্সিলরদের ভাষ্য, সামনে তাদের নির্বাচন ছিল। দলের প্রয়োজনে তারা মাঠে নেমেছিলেন। দল টিকে না থাকলে নিজেদের অস্তিত্বও টিকবে না, এমন শঙ্কা ছিল অনেকের মাঝে। তাই পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও ছাত্র-জনতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিরীহ মানুষের ওপর গুলি করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
আবার নিজেদের সক্ষমতা, দলের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করতে হিংস্রতার চরমে ছিলেন অনেকেই। উদ্দেশ্য ছিল, আসন্ন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলের সমর্থন পাওয়া। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ায় তাদের সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে। এখন কেউই প্রকাশ্যে নেই। কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, কেউ আত্মগোপনে আছেন। দলের অবস্থাও ছন্নছাড়া। আওয়ামী লীগ কবে নাগাদ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না।
কারই/জেবি