শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

ফরিদপুরের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব হারিয়েছেন খন্দকার মোশাররফ

কাজী রফিক
প্রকাশিত: ২৮ মে ২০২২, ১১:০৭ এএম

শেয়ার করুন:

ফরিদপুরের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব হারিয়েছেন খন্দকার মোশাররফ

ফরিদপুরের আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাবেক মন্ত্রী এবং সদর আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অর্জনের কমতি নেই। তবে শেষ বয়সে এসে যেন ফরিদপুরের রাজনীতি থেকে তাকে ছিটকে পড়তে হলো। নিজ জেলার রাজনীতির কর্তৃত্ব এখন আর তার হাতে নেই। 

২০০৯ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খন্দকার মোশাররফ প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব। একইসঙ্গে ফরিদপুরের রাজনীতিতে তৈরি করেন শক্ত অবস্থান। ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বার এমপি হয়ে প্রভাব আরও জোরালো হয় তার। একক আধিপত্য বিস্তার করেন ফরিদপুরজুড়ে। সরকারের তৃতীয় মেয়াদে টানা তিনবার এমপি হওয়ার পর আসে ক্ষমতার পতন। ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হতে শুরু করেন খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ‘হাতিয়ার’ হিসেবে পরিচিত স্থানীয় নেতারা। 


বিজ্ঞাপন


সবশেষ গত ১২ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য হলেও এই সম্মেলনে দাওয়াত পর্যন্ত পাননি খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ছিলেন না তারা অনুসারীদেরও কেউ।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর আগেও ফরিদপুরের রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল খন্দকার মোশাররফ হোসেনের অনুসারীদের। তবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে সে বলয় ভাঙতে শুরু করে। এখন জেলায় খন্দকার মোশাররফ হোসেনের অনুসারীদের কারোই দেখা মেলে না। কেউ নেতা পাল্টেছেন, কেউবা ছেড়েছেন জেলা।

কর্মী না থাকায় স্থানীয় রাজনীতিতে অনেকটা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গত এক বছরে নিজ নির্বাচনী জেলায় যাওয়া হয়নি তার। ২০২০ সালে তিনবারে মাত্র তিন দিনের জন্য এলাকায় গিয়েছিলেন তিনি। অথচ ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং আওয়ামী লীগে তার প্রভাব বিস্তার শুরু করেছিলেন। 

মুরগির ব্যবসায়ী থেকে বাবর বনে যান ‘টেন্ডার বাবর’। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিস, সড়ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের টেন্ডার বাবরের নির্দেশ ছাড়া কেউ পেতেন না। তিনি ফরিদপুরে মিস্টার ১৫ শতাংশ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কোনো কাজ করতে গেলে তাকে ১৫ শতাংশ টাকা দিতে হতো।

গত ৮ মার্চ মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন বাবর। ফলে স্থানীয় রাজনীতিতে খন্দকার মোশাররফের শক্তিতে ধস নামে। 

খন্দকার মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব ছাড়ার পর আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনৈতিক কাজের অভিযোগ ওঠে। আবার জেলায় তার শক্তিশালী হাত ছিল বরকত ও রুবেল। যারা দুজনই এখন কারাগারে। ২০২০ সালের ৭ জুন গ্রেফতার হন খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহচর সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। ৫০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির মামলায় তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাসা থেকেই। আটকের পর বেরিয়ে আসে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি টাকা পাচারের অভিযোগ। এছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য এবং নানা অপকর্ম তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বীকার করেন।

ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বর্তমান অবস্থা তার ‘অপকর্মের ফল’ বলে মনে করেন সাংবাদিক প্রবীর শিকদার। ঢাকা মেইলকে তিনি জানান, ক্ষমতার দাপটে স্থানীয় অনেকের সঙ্গেই যাচ্ছে তাই আচরণ করেছেন তিনি। 

প্রবীর শিকদার বলেন, তার বাড়ির পাশে তিনজন ভাই মিলে একটা তিনতলা বাড়ি করেছিল। যেটা তার পছন্দ হয়নি। কারণ তার বাড়িটাই দোতলা। ওই তিন ভাইয়ের নামে মামলা দিল। জেল খাটালো। এমন মানসিকতার মানুষ তিনি। এছাড়া তার অপকর্ম ও দুর্নীতির বিষয়ে স্থানীয়রা জানেন। তার অনেক অনুসারী গ্রেফতার হয়েছেন। অনেকেই নেতা পাল্টে নিজেদের জন্য একটা বলয় তৈরি করেছেন।

খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের কারণে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করার কারণে মামলার শিকার হতে হয়েছে প্রবীর শিকদারকে। একই কারণে স্থানীয় অনেক সাংবাদিক নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। 

এদিকে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি শামীম হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাধ্যক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। ফলে চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে আছেন। 

আবার মোশাররফ অনুসারীদের অনেকেই ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স’ নীতির কারণে কারারুদ্ধ হয়েছেন বলেও জানান জেলা আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা। 

খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুরের পৌর মেয়র অমিতাভ বোস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ফরিদপুরের রাজনীতিতে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এখন কোনো অবস্থানই নেই। শুনেছি, ব্যাপক দুর্নীতির কারণে এ অবস্থা হয়েছে।’

ফরিদপুরের জনগণ ভবিষ্যতে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের জায়গায় সংসদ সদস্য হিসেবে বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হককে দেখতে চায় বলেও জানান এই পৌর মেয়র।

কারই/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর