ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রশ্নে অস্থিরতা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিপিবি)। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। দলে একটি পক্ষের বিদ্রোহ করার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ দলটির নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে অস্থিরতা থামানো না গেল কেউ কেউ মুখ খুলতে পারেন।
অবশ্য দায়িত্বশীলরা বলেছেন, দলের মধ্যে রাজনৈতিক কোনো প্রশ্নে দ্বিমত নেই। ঐক্যমতের ভিত্তিতেই পার্টির কার্যক্রম চলছে।
বিজ্ঞাপন
সিপিবি সূত্র জানায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল্যায়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। গণঅভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনার পতনের পর গত ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সভা সিদ্ধান্তহীনভাবে শেষ হয়। পরবর্তীতে ২৯ আগস্ট আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নেতৃত্বের পদত্যাগ ও বিশেষ কংগ্রেস আহ্বানের আল্টিমেটামের মুখে ওই সভা বাতিল করে দলের প্রেসিডিয়াম কমিটি। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা রয়েছে। এই সভাতেও দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রশ্নে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দলটির কেউ কেউ।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনকে একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু দেখাতে চায় কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ নেতা। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটা অংশ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনতার আকাঙক্ষাগুলো, বিশেষত গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজ নির্মাণের প্রত্যাশাকে কেন্দ্রে রেখে রাজনৈতিক সংগ্রামে এগিয়ে যেতে চায়। মূলতঃ এই নিয়েই পার্টিতে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যা যেকোনো সময় বিদ্রোহে রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বড় একটা অংশের নেতৃত্বে দিচ্ছেন সিপিবি সভাপতি মো. শাহ্ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ, দুঃস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক দিবালোক সিংহ প্রমুখ। দলের ৪৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ২৭ জন এ অংশে রয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
অপরদিকে সাজ্জাদ জহির চন্দন, ক্বাফী রতন, জলি তালুকদারসহ ২১ জন ‘বিদ্রোহী’ পক্ষ নিয়েছে। তবে দলের সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ‘বিদ্রোহী’ পক্ষে সমর্থক দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
অভিযোগ আছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের লড়াই-সংগ্রামে সিপিবির নেতা-কর্মীরা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মূলত নিস্ক্রিয় ও বিরোধী ভূমিকা পালন করে। গত ২৬ জুলাই সকালে ঢাকায় কারফিউ ভেঙে প্রথম যে গানের মিছিল কিংবা ২ আগস্টের ‘দ্রোহ যাত্রা’ যেখানে প্রথম সরকার পতনের এক দফা ঘোষিত হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থান কর্মসূচিতে সিপিবির নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিরোধী ভূমিকায় ছিলেন। তারা সরকারের ‘লাইনেই’ ছিলেন।
সূত্র জানায়, সিপিবির অভ্যন্তরে প্রেসিডিয়ামের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। গণঅভ্যুত্থানে কৌশলে পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ নেওয়া, গণহত্যার নৈতিক সমর্থন দেওয়া, দলের মুখপত্র সাপ্তাহিক একতায় বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদন প্রকাশ করা, দলকে বিভক্ত ও নিষ্ক্রিয় রাখা, আন্দোলনের কার্যক্রমে বাধা দেওয়া ইত্যাদি গণবিরোধী কাজের দায়ে নেতৃত্বের পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলের নীতিগত দলিলসমূহ সমসাময়িককরণের জন্য গঠনতন্ত্রের ১৫ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে দ্রুততম সময়ে বিশেষ কংগ্রেস আহ্বানের জন্য নেতৃত্বের ওপর তৃণমূল থেকে কঠোর চাপ দেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ কংগ্রেসে নেতৃত্ব নির্বাচনে এক ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সিপিবির বর্তমান নেতৃত্ব। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে একক কর্তৃত্বে তারা দল পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ আছে একটা অংশের।
অভিযোগকারীরা বলছেন, সিপিবিকে বিভক্ত ও স্থবির করে রাখা, রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণে নানা বাধা সৃষ্টি, গণসংগঠনসমূহ বিভক্ত করার মাধ্যমে শক্তিক্ষয় ইত্যাদির মাধ্যমে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব হাসিনা’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমান নেতৃত্ব দেশ ও রাজনীতির চরম ক্ষতি করেছে।
দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাইলে সিপিবি সভাপতি মো. শাহ্ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। আমি ব্যক্তি হিসেবে কিছুই বলতে পারব না।’
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এক যুগ ধরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করছি। ‘দুঃশাসন হটাও, ব্যবস্থা বদলাও, বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোল’ এই স্লোগান নিয়ে আমরা এক যুগ ধরে আন্দোলন করছি। আমরা একটা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বিকল্প ক্ষমতায়নের কথা বলছি।
এক প্রশ্নে জবাবে রুহিন হোসেন বলেন, দলের মধ্যে কোনো সংকট নেই। আমাদের মধ্যে ছোট-খাট দ্বন্দ্ব থাকতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই। ঐক্যমতের ভিত্তিতেই পার্টি কার্যক্রম চলছে।
আগামী ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় পরিষদ’ সভায় অনুষ্ঠিত হবে বলে পার্টির পক্ষে থেকে জানানো হয়েছে।
বিইউ/এমআর