জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা বলেছি— আমরা প্রতিশোধ নেব না, এর মানে হচ্ছে আমরা নিজের হাতে আইন তুলে নেব না। কিন্তু যিনি সুনির্দিষ্ট অপরাধ করেছেন, তার বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং তাকে শাস্তি পেতে হবে।
তিনি বলেন, গণহত্যার বিচার করতে হবে এবং গত সাড়ে ১৫ বছরে যেসব অপরাধ করা হয়েছে, তার বিচার করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (০৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকার মগবাজারে আল-ফালাহ মিলনায়তনে ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সংগঠনের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি এসব কথা বলেন।
জামায়াতের আমির বলেন, হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে জামায়াতসহ বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে কারাগারে আটকিয়ে রেখে হয়রানি করা হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে গুম করা হয়েছে, যার প্রকৃত সংখ্যা জাতির কাছে অজানা। ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে আমাদের কর্মীদেরকে হত্যা করা হয়েছে।
শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের প্রত্যেকটা রাত প্রত্যেকটা দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত ছিল। আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসসহ মহানগরী ও জেলা এমনকি তৃণমূলের সব অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অফিসের সবকিছু লুট করা হয়েছে। কোনও জায়গায় আমাদের সামান্য স্পেস দেওয়া হয়নি। আমাদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে।
‘হিটলারের গ্যাস চেম্বারের মতো আমাদের দেশে আয়নাঘর তৈরি করা হয়েছে। শুধু জামায়াতে ইসলামী নয় বিরোধীদল বিএনপি, উলামায়ে কেরামসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের ওপর একই ধরনের তাণ্ডব চালানো হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ওপর ভিন্ন মাত্রায় তাণ্ডব চালানো হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
তিনি উল্লেখ করেন, বয়স্ক আলেমদেরকেও হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে আদালতে তোলা হয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েই জালিমরা ক্ষান্ত হয়নি বরং আলেমদের মুখ না খুলতে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
জামায়াত আমির আরও বলেন, ‘বিগত সরকার ক্ষমতার লোভে জেদের বশবর্তী হয়ে সুস্পষ্ট গণহত্যা চালিয়েছে। সরকার শুধু স্থলভাগেই নয়, আকাশ থেকেও গুলি চালিয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যা করেছে। স্বাধীন দেশে পরিচালিত এই গণহত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
‘আমরা বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই— খুনিদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দল হিসেবে সাড়ে ১৫ বছর পরে আমাদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করা হয়েছে। আমাদের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শেষ মুহূর্তে সরকার দিশেহারা হয়ে আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, ক্ষতিগ্রস্ত যারাই মামলা করবেন, আইনের আশ্রয় নেবেন— কোনও মানুষের ওপর যেন বেইনসাফি না হয়, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনও নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেন আসামি করা না হয়।’
কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার অধিবেশনে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি চাওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। দেশ স্বৈরশাসকের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে। কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয়ের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছে।
এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়ার জন্য মজলিসে শুরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
যৌক্তিক সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসহ সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
জামায়াতের আমির বলেন, দেশটা আমাদের সবার। ছাত্রদের আন্দোলনে আপামর জনতা অংশ নিয়েছে। এ আন্দোলনের সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি পেশার মানুষ শরিক হয়েছে। প্রবাসীরাও দেশবাসীর সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। আন্দোলন করতে গিয়ে তারা নিগৃহের শিকার হয়েছে। একটি দেশে ৫৭ জনকে গ্রেফতার করে আজীবন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমরা সরকারকে দাবি জানিয়েছিলাম তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাড়িয়ে আনতে হবে। আমরা এ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই যে, তারা উদ্যোগ নিয়েছেন এবং ওই দেশের সরকারকেও ধন্যবাদ জানাই তারা আন্দোলনকারীদের ক্ষমা করে মুক্তি দিয়েছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি করছি তাদেরকে মর্যাদাপূর্ণভাবে পুনর্বাসন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের কিছু চতুর ধনী মানুষ জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে ব্যাংকগুলো ফোকলা করে দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে গেছেন। এ অর্থ আমাদের সবার। এ অর্থ ১৮ কোটি মানুষের। এ অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং লুণ্ঠনকারীরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক তাদেরকে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এরা জাতির দুশমন, এরা লুটেরা। এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। আজকে সময় এসেছে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে। জাতির এই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনকে কেউ যাতে ব্যর্থ করে না দিতে পারে এজন্য সকলে মিলে আমরা পাহারা দেব। স্বাধীনতার পক্ষে আমাদেরকে আপসহীন অবস্থান নিতে হবে।
সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের পরিচালনায় অধিবেশনে নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ও মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
/এএস