শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হাজী সেলিমের একাল-সেকাল

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২২ মে ২০২২, ০৮:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

হাজী সেলিমের একাল-সেকাল

অবশেষে দুদকের মামলায় আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেলেন সরকার দলীয় প্রভাবশালী সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম। আদালতের নির্দেশে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিআইপি সেলে রাখা হয়েছে। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় তিনি সংসদ সদস্য পদও হারাতে পারেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

পুরান ঢাকার রাজনীতিতে দুই দশকের বেশি সময় ধরে হাজী সেলিমের একচ্ছত্র প্রভাব। তার রাজনীতির উত্থান মূলত বিএনপি থেকে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিএনপিপন্থী কমিশনার। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে ঢাকা-৮ (তৎকালীন) আসনের সংসদ সদস্য হন। তবে প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়েই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নাসির উদ্দিন পিন্টুর কাছে পরাজিত হন।  

হাজী সেলিম ও তার স্ত্রী গুলশান আরার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এক-এগারোর সরকারের সময় তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবার দেশে ফিরেন হাজী সেলিম। রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন।

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি। ঢাকা-৭ আসনে নৌকার মনোনয়ন পান মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তবে সেই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করেন। এতে দলে তার গুরুত্ব বাড়ে। ২০১৮ সালে আবারও আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন হাজী সেলিম।

মাঝে ২০১৫ সালে সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হতে চেয়েছিলেন হাজী সেলিম। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে সে বছর মেয়র পদে সাঈদ খোকনকে বেছে নেয় দল।

হাজী সেলিম বরাবরই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচিত-সমালোচিত। ২০১৯ সালে ঢাকা নদীবন্দর এলাকায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) অভিযান চালায়। অভিযানে সামনে আসে ঢাকা-৭ আসনের এই এমপির অনেক অবৈধ স্থাপনা। যা নদীর জায়গা দখল করে গড়া হয়েছিল।


বিজ্ঞাপন


২০২০ সালের হাজী সেলিমের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম গ্রেফতার হন। এক নৌ কর্মকর্তাকে মারধরের পর তার বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় হাজী সেলিম পুত্র ইরফানকে। এরপর আলোচনায় আসে হাজী সেলিমের অবৈধ সম্পদ ও দখলের নানা প্রসঙ্গ।  

স্থানীয়দের কেউ তার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। ফলে সরকারি-বেসরকারি বা কারও ব্যক্তিগত জমি পছন্দ হলেই তাতে নিজের বা নিজের স্ত্রীর নামে সাইনবোর্ড সেঁটে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে।

22

হাজী সেলিমের বেদখল করা শত কোটি টাকার জমি উদ্ধার করে এক সপ্তাহও রাখতে পারেনি সরকারি মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকের নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে জমিতে হাজী সেলিমের স্ত্রীর মালিকানা দাবির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।  

শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য স্কুল ভবন ও বধির কমপ্লেক্স নির্মাণে ২০০৫ সালে লালবাগের কামালবাগ এলাকায় এক একর জমি বরাদ্দ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। জমিটি সরকারের অকৃষি খাসজমি। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশের একমাত্র সরকারি এ উচ্চ বিদ্যালয়টি বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার প্রধান প্রকল্প। বধির স্কুলের পক্ষে বরাদ্দের নথি থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালে পাঁচ লাখ টাকা প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ দেওয়া হয় জমিটি। বধির স্কুল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বরাদ্দ পাওয়ার পর তিন বছর জমিটি তাদের দখলে ছিল। ২০০৮ সালে হাজী সেলিমের লোকজন জমির সীমানা খুঁটি উপড়ে ফেলে, লোকজনকে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে জমির দখল নেয়। এখন সেখানে হাজী সেলিমের ফিলিং স্টেশন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় চলে যাওয়া এক পরিবারের সম্পত্তি পড়েছিল হাজী সেলিমের বাড়ির পাশে। যা বছরের পর বছর ধরে খেলার মাঠ হয়ে ব্যবহার করা হচ্ছিল। সে খেলার মাঠে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে জায়গাটি রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজে পরিণত করেছিলেন হাজী সেলিম। স্থানীয়দের ভাষ্য, ওই জায়গায় ২০ তলা ভবন তুলতে চান স্থানীয় এই এমপি।

জানা গেছে, পুরান ঢাকা, কামরাঙ্গীর চর, কেরানীগঞ্জসহ ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজী সেলিমের সম্পদ। আর এই সম্পদের একটি বড় অংশ দখল করা। 

২০০৭ সালের মামলায় রোববার (২২ মে) কারাবাসে যেতে হয়েছে হাজী সেলিমকে। অর্থ আত্মসাতের এই মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো সংসদ সদস্য হাজী সেলিমকে কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন এবং চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

রোববার বিকেলে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলাম জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে তাকে কারাগারে ডিভিশন দেওয়া ও চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারক।

এর আগে আদালতে আত্মসমর্পণ করে যেকোনো শর্তে জামিনের আবেদন করেন হাজী সেলিম। একইসঙ্গে ডিভিশন ও চিকিৎসার জন্য আলাদা আবেদন করা হয়। যদিও তাকে ডিভিশন দেওয়ার ক্ষেত্রে আগেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনা আপত্তি নেই বলে জানান আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।

44

হাজী সেলিম ও তার স্ত্রী গুলশান আরার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকার স্পেশাল জজ আদালত-৭ এর বিচারক তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন হাজী সেলিম। পরে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাজী সেলিমকে খালাস দেন হাইকোর্ট।

পরবর্তীকালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে দুদক। শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করে পুনরায় শুনানির নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর এ মামলার বিচারিক আদালতে থাকা যাবতীয় নথি (এলসিআর) তলব করেন হাইকোর্ট। সে আদেশ অনুসারে নথি আসার পর আপিল শুনানি করা হয়।

শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৯ মার্চ রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের ভার্চুয়াল বেঞ্চ। রায়ে হাজী সেলিমের ১০ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়।

২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায়ের কপি আদালত থেকে নামে (রায় প্রকাশিত হয়)। পরে ৯ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়। আর রায়টি অফিসিয়ালি বিচারিক আদালতে কমিউনিকেট (পাঠানো) হয় ২৫ এপ্রিল। এরই মধ্যে গত ২৭ এপ্রিল থেকে কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩০ দিন সময় পান ঢাকার এই সংসদ সদস্য। সে হিসেবে আজ বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

হাজী সেলিমের কারাবাস প্রথমবার নয়। এর আগেও দুর্নীতির দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে।

 কারই/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর