মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘রাজনৈতিক সমাধান না হলে আন্দোলন শেষ হবে না’

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০৮:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

বারবার খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের পেছনে চালাকি দেখছেন ফখরুল
ফাইল ছবি

# কতজন মারা গেছে, সরকার কোনো তথ্য দিচ্ছে না
# গ্রেফতার ২ হাজার নেতাকর্মী 
# পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আন্দোলনে 
# কারফিউ প্রত্যাহার চায় বিএনপি

চলমান সংকটের রাজনৈতিক সমাধান না হলে আন্দোলন শেষ হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।


বিজ্ঞাপন


বুধবার (২৪ জুলাই) বিকেলে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, আন্দোলন শেষ হয়নি। অতীতের ইতিহাস দেখলে এটা স্পষ্ট যে, আন্দোলন এক পর্যায়ে হয়তো স্তিমিত হয়েছে, তারপরে তা আরও বেগবান হয়েছে। এবারের আন্দোলন একটা ‘আইওপেনার’। এবারকার আন্দোলনে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। এক বাচ্চা ছেলে ১৫/১৬ বছরের বয়স সে তার মায়ের কাছে এই বলে আন্দোলনে এসেছে যে, ‘আমি যাবো, সাধারণ মানুষ বেরিয়ে এসেছে, ওদের সঙ্গে আমাদের যেতে হবে। কারণ আমার রুটি-রুজির ব্যাপার আছে।’

তিনি বলেন, সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আজকে একদিকে কোটা আন্দোলনে ছিল শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে সব ক্ষেত্রে সরকারের চরম ব্যর্থতার কারণেই জনগনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েছে।

তিনি বলেন, সাময়িকভাবে সেনাবাহিনী নামিয়ে, দমনপীড়ন করে, নির্যাতন-নিপীড়ন করে, তারা এটাকে হয়তো থামিয়ে দিতে পারে। এটার যদি রাজনৈতিক সমাধান না করে তাহলে কিন্তু কখনো এটার শেষ সমাধান হবে না।


বিজ্ঞাপন


রাজনৈতিক সমাধানটা কি প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল স্পষ্ট ভাষায় বলেন, রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

গত কয়েকদিন যাবত বিএনপি মহাসচিব বিবৃতির মাধ্যমে দলের বক্তব্য উপস্থাপন করলেও বুধবার কারফিউ ৭ ঘণ্টা শিথিল থাকার মধ্যে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন বিএনপি মহাসচিব।

‘তারেকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অপচেষ্টা’

বক্তব্যের শুরুতে মির্জা ফখরুল বলেন, গত কয়েকদিন ধরে কারফিউ দেওয়ার পর থেকে সরকার অত্যন্ত সচেতনভাবে একটা জিনিস প্রমাণ করতে চাইছে যে, আন্দোলন, বিভিন্ন হত্যার ঘটনা, ভাঙচুর হয়েছে সব কিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে তারেক রহমান। এটা তাদের সবার কথার মধ্যে আসছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, তারা তারেক রহমানকে হেয় প্রতিপন্ন করা, তার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা এবং জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে বিএনপিকে দায়ী করা, বিরোধী দলকে দায়ী করতেই এসব করছে। সরকারের এসব বক্তব্য অমূলক, বিভ্রান্তিকর, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

তিনি বলেন, সরকার জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বলছে না। তারা যখনই কথা বলছে তারা কিন্তু কয়েকটি সরকারি স্থাপনায় আক্রমণ হয়েছে সেই কথাগুলোই বলছে। এই আন্দোলনের শত শত প্রাণ কেড়ে নিলো সেই ব্যাপারে তারা (সরকার) কোনো কথা বলছে না। পুলিশের গুলিতে যে মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে সেটার ব্যাপারে কিছু বলছে না। আজকে বলছে যে, যদি কেউ আহত হয়ে থাকে তাহলে সেটাকে দেখে প্রয়োজনে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করবে। অথচ এটা সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ব সরকারের।

তিনি বলেন, তাদের মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে তারা গোটা আন্দোলনটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করতে চায়। সরকার নিজেরাই কোর্টে গিয়ে রায়ট নিয়ে এসেছে। আপনাদের মনে থাকার কথা যখন সমস্যাটা শুরু হলো তখনই কিন্তু তারা বলতে শুরু করলো এটা আদালতের বিষয়, আদালতই সমাধান করবে। যখন পরে আরও বেশি বেগবান হয়েছে, তারা বলতে শুরু করলো অপেক্ষা করো, আদালত থেকে সমাধান আসবে। অর্থাৎ সমস্যার সমাধানে যদি শিক্ষার্থীদের সাথে, স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলতো তাহলে আজকে এতো দূর পর্যন্ত গড়াতো না।

‘এতো খারাপ অবস্থা দেখিনি’

মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের অবস্থা এতো খারাপ যা আর কখনো দেখিনি। একটা আন্দোলনকে দমন করার জন্যে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আর্মিকে নামানো হয়ছে কারফিউ দিয়ে। এতে সরকারের চরম ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। সরকার পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। কতজন মারা গেছে, কত জন আহত হয়েছে সে বিষয়ে সরকার কোনো তথ্য দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

জনগণ যাতে সত্য না জানতে পারে সেজন্য সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা তথা সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যম বন্ধ করে রাখার সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, তারা ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করেছে বলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা ইন্টারনেট চালুর সুরাহা করতে পারেনি। এতে করে সংবাদ মাধ্যমের কষ্ট হয়েছে, সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। আপনারা দেখেছেন যে, একটা ভিডিও তৈরি করে ব্যবসায়ীদের সভায় দেখানো হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করা হয়েছে। তার প্রমাণ হচ্ছে যে, চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ক্ষমতাসীন শ্রমিক লীগের একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে যে, তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল বিআরটিসির বাসে আগুন লাগানোর জন্য। প্রথম আলো পত্রিকায় খবরটি এসেছে।

‘কোটা আন্দোলনকারীদের সব দাবি পূরণ হয়নি’

কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিএনপির সমর্থন এখনো আছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, কোটা সংস্কারের আমাদের সমর্থন ছিল, এখনো আমরা দিচ্ছি। তাদের যে দাবিগুলো ছিল তা এখনো পূরণ করা হয়নি। তাদের দাবি ৮ দফা, সেগুলো কিন্তু এখনো হয়নি। শুধু কোটা নয়, আরও যে দাবিগুলো আছে অবশ্যই সেসব দাবি সরকারের পূরণ করা উচিত।

তিনি বলেন, এ সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা সেটা হচ্ছে যে, জনগনের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। সে কারণে তারা জনগনের চোখের ভাষা, জনগণের মনে কথা তারা কখনো বুঝতে পারে না। সেই কারণে তাদের এখন মূল ফোর্সকে অ্যাপ্লাই করে নির্যাতন-নিপীড়ন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।

তিনি বলেন, ২০১৪, ২০১৮ সাল এবং এবারকার কথা বলা হচ্ছে কখনোই কিন্তু আমরা নাশকতায় জড়াইনি, আমরা কখনো জবরদস্তি কিছু করতে যাইনি। সরকার আমাদের ওপরে আক্রমণ করেছে আমরা চেষ্টা করেছি প্রতিহত করার। অনেক সময় দেখা গেছে যে, আমাদের যে দাবি দাওয়াগুলো সেই দাবিগুলো সামনে নিয়ে এসেছি। আমাদের মূল দাবি একটাই যেটা নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি সেটা হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই বিষয়টিতে সরকার না গিয়ে সরকার নানা কথা বলছে। এটা রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে তা না হলে এটার কখনো সমাধান হবে না।

‘দুই হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার’

মির্জা ফখরুল বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা সরকার বন্ধ করে রাখায় আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভ হচ্ছেনা। আমাদের অফিসগুলোতে অভিযান চালিয়ে সব কিছু নিয়ে গেছে।  তালা লাগিয়ে দিয়েছে। ক্রাইম সিন ফিতে লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের জানা মতে, এখন পর্যন্ত আমাদের প্রায় দুই হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর, জামায়াতে ইসলামের মিয়া গোলাম পারোয়ার, ডা. আবদুল্লাহ মো. তাহেরসহ জাতীয় নেতাদেরকে তারা গ্রেফতার করেছে। বিএনপি মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।

‘নাশকতা: ওরা জনগণকে ভ্রান্ত ধারণা দিতে চায়’

মৃত্যুর সংখ্যার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, কত জন এই আন্দোলনে মারা গেছে, কত জন আহত হয়েছে এটা তারা (সরকার) জানাচ্ছে না। উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, ওরা গোটা জাতিকে ভ্রান্ত ধারণা দিতে চায়। সেখানে তারা কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের বিষয়টা পুরোপুরি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সরকারি স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুরের যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সামনে আনতে চায়। এখানে বিএনপির ওপর দোষ চাপাতে চায়।

বিএনপির ওপর নাশকতার যে অভিযোগ সরকার করছে তাকে ভিত্তিহীন দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা আন্দোলনের সঙ্গে থাকা আর নাশকতার মদদ দেওয়া এক জিনিস নাকি। নাশকতার মদদ তো দিচ্ছেন না তারা (সরকার)। তারা চাচ্ছেন যে এখানে নাশকতা হোক, সমস্যা হোক। বিএনপির চল্লিশ বছরের ইতিহাসে নাই যে, বিএনপি রাষ্ট্রীয় স্থাপনার ওপরে আক্রমণ করেছে, সেখানে কোনো সমস্যা তৈরি করেছে। আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে কোথাও কোনো রকমের রাষ্ট্রীয় স্থাপনার ওপরে বিএনপি আক্রমণ কখনো কখনো করেনি।

‘সত্য কথা বললেই রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে যায়’

মির্জা ফখরুল বলেন, এটা খুব পরিষ্কার সারা বিশ্বের কাছে যে, বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের জনগণের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আজকে এই আন্দোলনে জনসাধারণকে হত্যা করা হয়েছে সেই হত্যাগুলোর ছবি বিদেশে গেছে। সেখানে গণতান্ত্রিক দেশগুলো, গণতান্ত্রিক দেশের নেতৃবৃন্দ আছে তারা তো কথা বলবেই।

তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে আজকে নয়, বহুদিন ধরে তারা তার ভাবমূর্তি বিনষ্ট ও তাকে হেয়প্রতিপন্ন করছে, তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে, সাজাও দিয়েছে। তিনি ১৪ আগস্ট অলিম্পিক উদ্বোধন করবেন। গোটা বিশ্বে তিনি এতটা সমাদৃত, এতোটা বরণ্যে তিনি নাকি রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য দিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে। সত্য কথা বললেই রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে যায়, সত্য কথা বললে গণবিরোধী হবে। গণবিরোধী তো হচ্ছে আওয়ামী লীগ, আসল রাষ্ট্রবিরোধী হচ্ছে আওয়ামী লীগ। গত ১৫ বছর যাবত তারা যতগুলো কাজ করেছে সবগুলো এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছে,সব গুলো জনগণের বিরুদ্ধে গেছে।

‘কারফিউ প্রত্যাহার চাই’

মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা প্রথম দিন থেকে বলে আসছি আমরা কারফিউ প্রত্যাহার চাই। জনগণের শান্তির স্বার্থে কারফিউ অবশ্যই প্রত্যাহার করা উচিত।

বিইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর