গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের পর থেকে পাল্টে যায় বিএনপির রাজনীতির গতিপথ। মহাসচিবসহ একের পর এক শীর্ষ নেতার গ্রেফতারের পর শুরু হয় টানা হরতাল-অবরোধ। কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ থাকায় সেদিকে কেউ পা বাড়ায়নি এই লম্বা সময়ের মাঝে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে কর্মসূচিও ছিল ঝটিকা মিছিলে সীমাবদ্ধ। শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশের অবস্থা ছিল অনেকটা একইরকম। কিন্তু বিজয় দিবসকে ঘিরে নেতাকর্মীরা যেন আড়মোড়া ভেঙে প্রকাশ্যে এসেছেন। নয়াপল্টনে বিজয় র্যালির পাশাপাশি সারাদেশে নেতাকর্মীদের যেন ঢল নেমেছে।
দলের হাইকমান্ড সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সরকারকে চাপে রাখতে এবং নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখার কৌশল খুঁজছে। সেক্ষেত্রে কর্মসূচিতে ভিন্নতা আনা যায় কিনা সেই চিন্তাও আছে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
অবশ্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা নিয়ে সংশয় আছে নেতাদের মধ্যেও। তবে মাঠের কর্মীরা বলছেন, শীর্ষ নেতাদের পাশে পেলে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, অনেকটা ছন্নছাড়া নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ করতে এরই মধ্যে সুনির্দিষ্ট করে নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ভার্চুয়াল বৈঠকে দেশজুড়ে দলের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন।
সূত্র আরও বলছে, সভা-সমাবেশের ওপর নির্বাচন কমিশন নিষেধাজ্ঞা দিলেও এরমধ্যেই ১৮ ডিসেম্বরের পর নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তা আছে বিএনপিতে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে অনেকটা ‘ডু অর ডাই’ আন্দোলনের ভাবনা রয়েছে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
দলটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে নির্বাচন বানচাল করতে কঠোর কর্মসূচি দিয়েছিল। প্রয়োজনে বিএনপি তার চেয়েও কঠোর কর্মসূচি দেবে।’
আর ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাসান টিটু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মাঠের নেতাকর্মীরা প্রস্তুত। দল থেকে যে নির্দেশনা আসবে তা বাস্তবায়ন করতে আমরা পিছপা হবো না। আমাদের প্রত্যাশা বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে দল নতুন কর্মসূচি দেবে।’
বিজয় র্যালি করে নেতাকর্মীরা চাঙ্গা, তালা খুলেনি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের
২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পর প্রথমবার, দীর্ঘ ৪৯ দিন পর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বড় ধরণের কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয় র্যালিকে কেন্দ্র করে নির্ধারিত সময়ের আগে থেকেই নয়াপল্টনে আসতে থাকেন নেতাকর্মীরা। ধীরে ধীরে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পুরো এলাকা। অবশ্য মহাসমাবেশের দিন থেকে মূল ফটকে তালাবদ্ধ বিএনপির কার্যালয়ের তালা আজও খুলেনি।
এদিকে কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের পাশাপাশি বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের অনেককে প্রকাশ্যে দেখা গেছে। ঢাকার দুই মহানগরের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জের নেতাকর্মীরাও অংশ নিয়েছেন বিজয় র্যালিতে।
গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনকে হরতাল-অবরোধে দেখা না গেলেও র্যালিতে দেখা গেছে। বিএনপির পরবর্তী ভাবনা নিয়ে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যারা বলে বিএনপি নেই তারা র্যালিটা দেখে যেতে পারে। এত নির্যাতনের পরও যে বিএনপির লোক কমেনি সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে। এই কর্মীরাই সরকারের পতনের আন্দোলন তরান্বিত করবে। সফলও হবে।’
শোভাযাত্রায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী ছাড়াও অনেকদিন পর প্রকাশ্যে এসেছেন অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।
এছাড়া ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, কৃষকদল, মৎস্যজীবী দল, শ্রমিক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নেন।
শনিবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়। শান্তিনগর গিয়ে পরে আবার নয়াপল্টনে ফিরে আসে মিছিলটি। সম্প্রতি বিএনপির কোনো মিছিলে এত নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। পুরো র্যালি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান থাকলেও শান্তিপূর্ণভাবেই সব শেষ হয়েছে।
এদিকে র্যালির উদ্বোধনের আগে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। কিন্তু বিজয় দিবসকে পাল্টে দিয়েছে এই সরকার। তারা এখন দিবসটিকে পরাজয় দিবসে পরিণত করেছে। আমরা রাজপথে আছি এবং থাকব। সাহস থাকলে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন দিন।
অবশ্য বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গ্রেফতার, হামলার পাশাপাশি কর্মসূচি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে তারা রাজপথে চাইলেও সক্রিয় হতে পারেননি। বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে আবারও মাঠে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চান।
বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনেকদিন পর হলেও নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে। এটা ধরে রাখতে হবে যে কোনোমূল্যে। যদিও সরকারের প্রশাসন এবং দলের লোকজন ভোটের সময় যত এগিয়ে আসবে আরও হার্ডলাইনে যাবে সেটাও মাথায় রাখতে হবে।’
গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর থেকে অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যায় বিএনপি। এরইমধ্যে ১০ দফায় অবরোধের কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। তবে প্রতিনিয়ত কর্মসূচির পক্ষে প্রচুর ঝটিকা মিছিল হলেও নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা খুব একটা দেখা যায়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকারের নানা ধরণের চাপের মধ্যেও বিএনপির নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছে, আন্দোলনের প্রতি তাদের কোনো ধরণের আগ্রহ কমেনি এটা আজ আবার প্রমাণ হয়েছে। কর্মীদের এই সক্রিয়তা কিভাবে ধরা রাখা যায় সেই চিন্তা অবশ্যই করতে হবে। আমরা সেটা করব।’
সেক্ষেত্রে বিএনপি কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই তেমন কিছু ভাবতে হলে দল ভাববে। কারণ আমাদের তো দাবি আদায় করার বিকল্প নেই।’
এদিকে র্যালি শেষে আবারও বিএনপি নেতাকর্মীরা হারিয়ে যাবে কিনা- এমন প্রশ্ন ছিল মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠে আছি, থাকব। সামনে এই উপস্থিতি আরও বাড়বে। এই কর্মীরাই আন্দোলনকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে।’
বিইউ/এএস