শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

জাতীয় সরকার: আশাবাদী বিএনপি, মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিত্রদের

মো. ইলিয়াস
প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০২২, ০৯:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

জাতীয় সরকার: আশাবাদী বিএনপি, মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিত্রদের
কোলাজ: ঢাকা মেইল

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারের যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, সবাইকে নিয়েই এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করবেন বলে তারা মনে করছেন না। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সরকারবিরোধী অন্তত ৩০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি।

তবে মিত্ররা বিএনপির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এর প্রক্রিয়া নিয়ে কারও কারও দ্বিমত রয়েছে। বিএনপির প্রস্তাব এখনও পরিষ্কার নয় বলে মনে করছেন তারা। যদিও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছার ব্যাপারে তারাও আশা প্রকাশ করছেন।

অনেক দিন ধরেই সরকারবিরোধী সব পক্ষকে নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য করার চেষ্টা করছে প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। গত ২৯ মার্চ লন্ডনে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এক অনুষ্ঠানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় সরকারের নতুন ধারণার কথা বলেন। ধারণাটি হচ্ছে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাদের সবাইকে নিয়েই জাতীয় সরকার গঠিত হবে। নির্বাচনে মিত্র দলগুলো জিতলেও সরকারে থাকবে, হারলেও থাকবে।

এরপর গত ৩০ মার্চ যৌথসভা শেষে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা নির্বাচন চাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। সেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পরে যারা আন্দোলন করেছে তাদের নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করব-এটা আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেব বলেছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় সরকারের যে রূপরেখা ঘোষণা করেছে বিএনপি, এর খসড়া রূপরেখা ও কর্মসূচি তৈরি করছে দলটি। খুব দ্রুতই মিত্র দলগুলোর কাছে তা নিয়ে হাজির হবে বিএনপি।

বিএনপি নেতারা যা বলছেন
জাতীয় সরকার নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জাতীয় সরকার নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির আলোচনা চলছে। ফাইনাল হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’


বিজ্ঞাপন


বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জাতীয় সরকার নিয়ে বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনা চলছে। এতে ভালো অগ্রগতি রয়েছে। এটাতো কারও কাছে অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কিছু নেই। এর বাইরে তো কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। দেশের আমূল পরিবর্তন আনতে হলে একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া কেউ করতে পারবে না। সে আমূল পরিবর্তনের জন্য জনগণের সমর্থন থাকতে হবে, মতামত থাকতে হবে। এটাতো কয়েকজন মিলে দেশ প্রবর্তন করা সম্ভব নয়।’

জাতীয় সরকারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কাজ চলছে, অগ্রগতি ভালো। পুরোপুরিভাবে এখন কিছু হয়নি, তবে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকের সাথে এ বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার। একেকজনের একেকরকম বক্তব্য থাকে, আমরা চাচ্ছি সমগ্র জাতি যাতে এক হয়, এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে।’

উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্নমত মিত্রদের
সরকারবিরোধী যেসব দল রয়েছে তাদের মধ্যে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি ইতিমধ্যে একটি জাতীয় সরকারের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে। তারা মনে করে, বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করে জাতীয় সরকার গঠন করে তাদের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে।

গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের গণফোরামও মনে করে, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে জাতীয় সরকার গঠন জরুরি।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপি যে জাতীয় সরকারের ধারণা দিয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই, সাধুবাদ জানাই। প্রথমে জাতীয় সরকারের এই ধারণাটা আমরাই দিয়েছি। এটা বলেছি জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার হরণকারী, সংবিধান লঙ্ঘনকারী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে 'জনগণের ভোটাধিকার' নিশ্চিত করা অর্থাৎ সাংবিধানিক চেতনায় রাষ্ট্রকে পুনর্বহাল করাই এখন প্রধান 'এজেন্ডা'।

রব বলেন, ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে যে গভীরতম জাতীয় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তাকে পুনরুদ্ধার করার অন্যতম পন্থা হচ্ছে 'জাতীয় সরকার'। জাতীয় জীবনে গভীর শাসনতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে জাতীয় সরকারের পন্থাই অনুসরণ করতে হয়। গণবিচ্ছিন্ন অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বিজয়ী শক্তির নেতৃত্বেই 'জাতীয় সরকার' গঠিত হবে। প্রথম আমরা ১৯৭২ সালে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু এসে প্রতিষ্ঠা না করার কারণে আজকে পঞ্চাশ বছর পরে এসে দায়ী আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করার কারণে।’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অপজিশন যারা রয়েছে তারা এক রকম বলেছেন এবং বিএনপির আরেক রকম বলেছেন। জাতীয় সরকারের স্লোগানকে আমি এবং আমার দল সঠিক মনে করি না। কারণ আপনি যখন জাতীয় সরকারের কথা বলবেন তখন সমস্ত জাতির প্রতিনিধিত্ব করবে তাইতো। জাতীয় সরকারের ধারণা নিয়ে তো আর লাভ হবে না; সবাইকে নিয়ে এখন সরকার করতে পারবেন? বিশেষ করে আওয়ামী লীগসহ যে গ্রুপটি রয়েছে তাদেরকে কেন নেবেন না? পরবর্তী সময়ে যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করবেন সেটা পারবেন না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যে বিভাজনটা রয়েছে জামায়াত বা ইসলামপন্থীদের নিয়ে সরকার করা, সেটা যারা দাবি করেছেন তারা তো রাজি হবেন না। তাহলে জাতীয় হয় কী করে।’

মান্না বলেন, ‘কনসার্নটা হচ্ছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তৈরি করবে। এটাকে আবার কেয়ারটেকার সরকার বলা উচিত হবে না আমি মনে করি। আমাদের সংবিধানিক কনসেপ্টটা হচ্ছে, কেয়ারটেকার সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে যাবে। ওই সময় তো সেই কেয়ারটেকার সরকার তিন মাসের জায়গায় দুই বছর নিয়েছে। এখন প্রশাসনে এত দলীয়করণ, নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, আমি মনে করি মিনিমাম তিন বছর লাগবে। এটা বলার পরে সবাই তো একমত যে, একটা টাইম তো দিতেই হবে, না হয় এটা পারবে না। এখানে বিএনপির কনসেপ্ট হচ্ছে জাতীয় সরকার নির্বাচনের পরে করবে। যারা নির্বাচিত এবং নির্বাচিত হয়নি তাদের নিয়ে। যারা নির্বাচনে জিতবে তারা সরকার গঠন করবে সে যদি অন্য কোনো দলকে নিয়ে করতে চায় করতেই পারে। কিন্তু ইলেকশনটা কেমন হবে সেটা নিয়ে তারা বলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তিন মাসের সরকার। তারা কি আশা করে তিন মাসের মধ্যে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করে নির্বাচন করা যাবে? কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবাই একমত রয়েছে।’

জানতে চাইলে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপির জাতীয় সরকারের ধারণা নিয়ে যে বক্তব্য আমরা সংবাদমাধ্যমে জেনেছি, জাতীয় সরকার নিয়ে এতদিন যাবত যে আলোচনা হয়েছে; বাংলাদেশের সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, ভোটাধিকার এসব কিছু তো একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব নয়। আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে। একই সঙ্গে দেশ একটি গণতান্ত্রিকব্যবস্থা, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তী সময়ে সব নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সেই নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে।’

সাকি বলেন, ‘অনেকগুলো সাংবিধানিক এবং আইনি সংস্কার দরকার পরিবর্তন দরকার। সংবিধান সংস্কার এবং আইনি পরিবর্তনের জন্য এই জায়গাটায় ইতোমধ্যে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সামনে এসেছে এবং আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে বহুদিন ধরে লড়াই করেছি। এছাড়া আমাদের দল থেকে প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। এদিকে বিএনপি বলেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবিধানিক এবং আইনি পরিবর্তন দরকার। আর এটা তারা একা নয়, সবাইকে নিয়েই করতে চায়। সে দিক দিয়ে আমরা যে জাতীয় ঐক্যমতের কথা বলেছি এই প্রস্তাব অর্থাৎ নির্বাচন পরবর্তীকালে। তাদের এই প্রস্তাব সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে স্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাদের ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ। তাদের এ প্রস্তাব নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এটা নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আমরা দলগতভাবে আলোচনা করব। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সাংবিধানিক আইনি প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং সেটা করার জন্য জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি করা। সে ক্ষেত্রে বিএনপি একটি বড় দল হিসেবে এটা ইতিবাচক ভূমিকা।’

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক বলেন, ‘নির্বাচনের পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নাম জাতীয় হবে, নাকি তত্ত্বাবধায়ক হবে, নাকি তদারকি হবে; এটা নিয়ে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু মর্মবস্তু একই। সেটা হলো, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সেই দিক থেকে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছে এবং আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছি মর্মবস্তু একই।’

এমই/জেবি/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর