বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থা গুরুতর জানিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে হুঁশিয়ার দিয়ে বলেছেন, তার কিছু হলে জনগণ আপনাদের ক্ষমা করবে না। ফখরুল বলেন, ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসা নিয়ে তার পরিবার সরকারের কাছে একাধিকবার আবেদনই করেননি, প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথাও বলেছেন। দেশের মানুষ এত বোকা নয়। তারা বুঝেছে শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া। তাকে যদি আটক রাখা যায় তাহলে তারা (সরকার) অবৈধ শাসন টিকিয়ে রাখতে পারবে। আজকে তাই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চায়। দেশের মানুষ পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চায়, খালেদার কিছু হলে জনগণ আপনাদের ক্ষমা করবে না।’
সোমবার (৯ অক্টোবর) বিকেলে নয়াপল্টনে এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে এই সমাবেশের আয়োজন করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি।
বিজ্ঞাপন
দুপুর ২টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টা থেকেই মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন নেতাকর্মীরা। মির্জা ফখরুল যখন মঞ্চে আসেন তখন বিজয়নগর থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।
সমাবেশের শেষে খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে আগামী ১৪ অক্টোবর বিএনপি নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে বেলা ১১টা থেকে তিন ঘণ্টার গণঅনশন কর্মসূচির ঘোষণা দেন মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজ সকালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় নিয়োজিত বোর্ডের চিকিৎসকরা পরিষ্কার করে বলেছেন, দেশে যা যা করার দরকার করা হয়েছে, এখন তাকে সুস্থ করতে হলে বিদেশে না নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।’

বিজ্ঞাপন
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘খালেদা জিয়া দেশে সহনশীল রাজনীতি সৃষ্টি করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েম করেছেন। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৭৬ দিন হরতাল দিয়েছে। আজকে তারা তা মানছেন না। এই আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এরা ফ্যাসিস্ট। আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়েছে।’
ফখরুল বলেন, ‘আজকে মিথ্যা মামলায় ফরমায়েশি রায় দিয়ে বিএনপির ১৫ জন নেতাকে চার বছর করে সাজা দিয়েছে। গতকাল আরও ১৫ জন সাবেক ছাত্রনেতাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারা মনে করছে এদের আটক রাখলে বিএনপিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। প্রতিটি সাজার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কর্মী সৃষ্টি হচ্ছে। বিএনপি হচ্ছে ফিনিক্স পাখির মতো। অনেক সিনিয়র নেতাকে সাজা দিয়ে আটক রেখেছে। এগুলো করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারবেন না।’
মহাসচিব বলেন, ‘এবার ক্ষান্ত হোন। আর অত্যাচার করবেন না। আপনারা বুঝতে পারছেন না আপনাদের জন্য কী দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আইয়ুব-ইয়াহিয়াও পারে নাই, এরশাদ পারে নাই। আপনিও পারবেন না।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গতকাল প্রধান বিচারপতি বলেছেন, রাজনীতির বাইরে গিয়ে বিচার করবেন। রাজনীতির মধ্যে থাকা যাবে না। আজকেও রাজনৈতিক কারণে ১৫ জনকে ফরমায়েশি রায় দিয়ে নেতাদের জেল দেওয়া হয়েছে। সরকার আদালতকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করছে।’
ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ফরহাদ হালিম ডোনারের সভাপতিত্বে আমিনুল হক ও লিটন মাহমুদের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাডভোকেট আজম খান, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক খান, ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান প্রমুখ।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘এ সরকারের কাছ থেকে সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তি আশা করা যায় না। এরা দানবীয় সরকার। একটি মৃত্যু পথযাত্রী সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রমাণ করে এরা কতটুকু অসভ্য। খালেদা জিয়াই এ দেশে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিল। তারা বাকশালের পেটে ঢুকে গিয়েছিল। খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র এনেছিলেন। আজকে সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। কোন সংবিধানের দোহাই দিয়ে আপনারা ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বললেন, খালেদাকে আমি ক্যান্টমেন্ট থেকে বের করেছি। তাহলে কোর্টের দোহাই দিলেন কেন? মূলত সেদিন থেকেই তাকে হত্যার ছক তৈরি করা হয়েছিল।’
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা হাজার বলছি। কিন্তু অবৈধ সরকার শুনছে না। আজকে ১৫ জনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন। বিচার বিভাগকে কাজে লাগিয়ে আবারও একদলীয় নির্বাচন করতে চায়। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের কারো ঠিকানা জেলখানা অথবা ইলিয়াস আলীর অবস্থা হবে। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেছেন তার উত্তর দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই। বিএনপি নেতাকর্মীরা কখনো এই অসভ্য ভাষায় কথা বলে না। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) কাউকে চিকিৎসা করতে দেবেন না। আপনার চিকিৎসাও বাংলাদেশে হবে না। কেউ চিকিৎসা করাবে না। শেখ হাসিনার পতন হওয়া ছাড়া কেউ মাঠ ছাড়বে না। সভা সমাবেশে মাধ্যমে এই সরকারের পতন হবে না। কঠিন কর্মসূচির প্রস্তুতি নেন।’

ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘খালেদা জিয়া সম্মুখ দরজা দিয়ে রাজনীতিতে নেমে জনগণের নেত্রী হয়েছেন। এটি সরকার সহ্য করতে পারেনি। তাই তাকে অন্তরীণ করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, বিনা চিকিৎসায় হত্যা করার চেষ্টা করছে। আজকে যারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছে তাদের সহ্য করতে পারে না। আজকে বিনাদোষ তাকে আটক রাখা হয়েছে। তারা ভেবেছিল বাকশাল করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে। তাই বিএনপিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। মনে করেছিল খালেদাকে ধ্বংস করলে বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে দেশের ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়ে আছেন।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন করেছি সে দেশে আইনমন্ত্রী বেআইনি কথা বলে। অর্থমন্ত্রী অনর্থের মূল। পররাষ্ট্র যে ভাষায় কথা বলেন, মনে হয় উনি অন্য দেশের মন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই ব্যবসায়ীর ভাষায় কথা বলেন। যে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করেছি, সে গণতন্ত্র ভোগ করতে পারছি না। গণতন্ত্রের মাকে আজকে বন্দী রাখা হয়েছে। আজকে দেশের কোটি কোটি মানুষ তার জন্য দোয়া করছেন। আজকে নির্বাচনে অযোগ্য করার জন্য নেতাদের কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। সরকার এগুলো করে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায়।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আজকে যারা খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় ভোট চুরির প্রকল্পের অংশ হিসেবে আটক রেখেছে তারা শুধু সংবিধান লঙ্ঘন করেনি, তারা হত্যা পরিকল্পনার আসামি। আজকে ডাক্তাররা পরিষ্কার করেছে তারা খালেদাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনেকে শঙ্কা করছেন তাকে খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে এমন কিছু দেওয়া হয়েছে, তার জন্য বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। এটি ফ্যাসিস্টদের কাজ। তাদের কাজ হত্যা করা, জেলে নেওয়া, গুম করা। এই ফ্যাসিস্ট যতদিন থাকবে দেশনেত্রীর মুক্তির সুযোগ দেখছি না। তাই আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে। দেশকে মুক্ত করতে হবে। আওয়ামী লীগ বলছে বিএনপির সাথে আলোচনার সুযোগ নেই। থাকবে কী করে। তাহলে ভোট চোরের প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কীভাবে?’
সেলিমা রহমান বলেন, ‘সরকার জিয়া পরিবারকে ভয় পায়। তারা জানে খালেদা জিয়া মুক্ত হলে এ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। একটি মানুষ কতদিন বাঁচবে কেউ বলতে পারবে না। অথচ, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে যে অযাচিত কথা বলেছেন সারাদেশের মানুষ তার বক্তব্যে ছি ছি দিচ্ছে।’
বিইউ/জেবি

