বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে চার মাস আগে ভিসানীতি ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবার তা কার্যকরের কথা জানিয়েছে দেশটি। এরপর থেকে আলোচিত হচ্ছে- কারা পড়বেন এই ভিসানীতির আওতায়। দেশটির পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের নেতাদের কথা বলায় দুই পক্ষই ঝুঁকির বিষয়টি একে-অন্যের ওপর ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতারাও বলছেন- ভিসানীতি নিয়ে দল বা সরকারে কোনো চাপ নেই। বরং নির্বাচন ঠেকাতে সহিংসতা করলে বিপদে পড়বেন বিএনপি নেতারা।
অন্যদিকে ভিসানীতিতে চাপের কোনো কারণ দেখছেন না রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি নেতারা। তারা এর পুরো দায় সরকারি দলের ওপর দিচ্ছেন। বলছেন, যা হওয়ার তা ক্ষমতাসীন দলের জন্য হবে।
বিজ্ঞাপন
তবে সবচেয়ে স্বস্তিতে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। ভিসানীতি নিয়ে তারা অনেকটা নির্ভার। দলটির নেতারা মনে করছেন, ভিসানীতি নিয়ে অন্যদের চিন্তা থাকলেও তাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ জাপা কখনো ভোটে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাদের রাজপথে শক্তি দেখানোর সাংগঠনিক ক্ষমতাও নেই।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে কোনো পক্ষেরই তৃপ্তিতে ভোগার কারণ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশটি যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা ধীরে ধীরে আরও কঠোর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বিশ্বের নেতা ও অভিভাবক। সুপার পাওয়ারসম্পন্ন দেশ। আবার বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে মুক্ত বিশ্বের দেশ, গণতান্ত্রিক দেশ। সে কারণে সদস্যভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে তারা ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে। মনে রাখতে হবে তারা এখানেই থেমে থাকবে না। তারা অলআউটের দিকে যাবে।’
বিজ্ঞাপন
গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসানীতি ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ঘোষণা অনুযায়ী, নির্বাচনে কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন এবং নাগরিক ও গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতায় যারা বাধা দেবে, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে বলে জানায় দেশটি। এই ঘোষণার চার মাস পর গতকাল শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বিবৃতিতে জানান, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা এই ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন- এমনটাও জানানো হয় বিবৃতিতে। অবশ্য নীতি অনুযায়ী কারা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন তা প্রকাশ করবে না যুক্তরাষ্ট্র।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৫৭তম সাধারণ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানকালে এই বিবৃতি দেওয়া হয়। একই দিনে মিট দ্যা প্রেসে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সময় ভিসানীতির ইস্যুতেও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এসময় নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আশা করেন, বিরোধী দলসহ নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টাকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।
সরকারপ্রধান আশা প্রকাশ করেন, যে দেশ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা উভয় পক্ষ থেকে বা নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি বিবেচনা করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে কোনো পক্ষেরই তৃপ্তিতে ভোগার কারণ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশটি যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা ধীরে ধীরে আরও কঠোর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরদিন দেশে একাধিক অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একাধিক নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তারা সবাই ভিসানীতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো চাপ নেই বলে দাবি করেছেন।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতির পর থেকে রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে যাদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন তাদের মধ্যে বেশি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
কী বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা
চিকিৎসা শেষে শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মার্কিন ভিসানীতি সরকার পরোয়া করে না বলে জানান।
কাদের বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ সরকার। অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন যারা চায়, তাদের ভিসানীতি নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।’
অন্যদিকে মার্কিন ভিসা বিধিনিষেধ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করায় প্রধান বিরোধী দল সহিংসতা করতে পারবে না।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভিসানীতি নিয়ে সরকার কোনো চাপ অনুভব করছে না। তার দাবি, ভিসানীতি নিয়ে বিরোধী দলেরই চাপ অনুভব করার কথা। এটি তাদের ভাবার কথা।
একই সুরে কথা বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ভিসানীতিতে সরকার কিংবা আমাদের দল কোনো চাপ অনুভব করছে না। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই। এটির পরিপ্রেক্ষিতে বরং বিএনপির ওপরই চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তারা বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে।
আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ভিসানীতি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব ব্যাপার। তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এখানে আমাদের কিছু বলার নেই। কাকে ভিসা দেবে, নাকি না দেবে, সেটা তাদের নিজস্ব এখতিয়ার। সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই।
তবে ক্ষমতাসীন দলের সব নেতাদের ভাষ্য সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়।
কী বলছে বিএনপি
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলেনি বিএনপি। তবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশটির এমন ঘোষণাকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে বাংলাদেশের জন্য একে ‘অপমানজনক ও লজ্জাজনক’বলছেন তিনি। এজন্য এককভাবে সরকারকে দায়ী করছেন বিএনপি মহাসচিব।
গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এজন্য বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো দায় নেই, এককভাবে সরকারই দায়ী।’
বিবৃতিতে বিরোধী দলের বিষয়ে হয়েছে, সে প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, গত ১৮ বছর ধরে বিরোধী দলের তো কোনো ভূমিকাই নেই, তারা এমন কোনো কাজ করেননি, যে কাজের জন্য একটা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা মেইলকে বলেন, এটা নিয়ে আমাদের টেনশনের কী আছে? আন্তর্জাতিক বিশ্বকে তো বোকা বানানোর সুযোগ নেই। শোনা যাচ্ছে সরকারি দলের অনেক নেতা, প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এই ভিসানীতির আওতায় পড়েছে।
দুদু বলেন, প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র আছেন। শুনতেছি তিনি অতি তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। আসেন, দেশে দাঁড়িয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তাহলে কিছুটা হলেও রক্ষার পথ পাওয়া যাবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য ফকরুল ইমাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ভিসানীতি নিয়ে আমরা তো কোনো চাপ দেখছি না। কারণ আমরাও তো নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। আসলে যেটা হয়েছে সেটা হলো ওইভাবে আন্দোলন করার মতো সাংগঠনিক শক্তি তো আমাদের নেই। আমরা সংসদে কথা বলি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছি। আর আমরা তো নির্বাচনে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াই না। সুতরাং আমাদের জন্য কেন দুঃশ্চিন্তার কারণ হবে ভিসানীতি?
‘যুক্তরাষ্ট্রকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে লাভ নেই’
ঢাকা মেইলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘ইটস নট এ গুড নিউজ। যুক্তরাষ্ট্রকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে লাভ নেই। আর যারা এখন চাপ নেই, আমাদের জন্য চিন্তার কারণ নেই বলছেন তারা নিজেদের জাহির করতে এসব কথা বলছেন। তারা যেভাবে বলছেন বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্টভাবে বলেছে সরকার ও বিরোধী দলের কথা। অফিসিয়াললি বিরোধী দল তো জাতীয় পার্টি। তাদের এক অংশ সরকারের স্বার্থ দেখছে। আরেক অংশ বিরোধী দল হিসেবে আছে।’
এই বিশ্লেষক বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা কাকে দিয়েছে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি অনুযায়ী নাম প্রকাশ করবে না। ফলে কাকে দেওয়া হয়েছে তিনি ছাড়া পরিবারের লোকজনও জানার কথা নয়।’
সামনের দিকে তাহলে কী হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এরপর ব্যক্তিগতভাবে স্যাংশন দেওয়া হতে পারে। জিএসপি সুবিধা বাতিলের মতো পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে।’
বিইউ/জেবি