ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। এ সময়কালে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন মেগা উন্নয়ন প্রকল্প দৃশ্যমান হয়েছে, হচ্ছে। আর এই মেগা প্রকল্পই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে দলটির ‘ট্রাম কার্ড’ হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দৃশ্যমান এসব উন্নয়ন প্রকল্প তরুণ ভোটারদের যেমন আকৃষ্ট করবে, তেমনি এই অর্জনগুলো নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়ও সুবিধা পাবে বলে মনে করছেন তারা।
ইতোমধ্যেই পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল চালু হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ এর সুফল ভোগ করছে। ফলে আগামীর নির্বাচনে এসব উন্নয়ন গুরুত্ব পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। এছাড়া নির্বাচনের আগে আরও কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখেই ভোটের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনের আগে উন্নয়নের চমক ভোটের রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিজ্ঞাপন
ইতোমধ্যে রাজধানীসহ সারাদেশেই দুইদিনব্যাপী ‘উন্নয়ন শোভাযাত্রা ও শান্তি সমাবেশ’ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে টানা তিন মেয়াদে সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয় ওই শোভাযাত্রায়।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ডোর টু ডোর আমাদের দলের উন্নয়ন কার্যক্রম প্রচার করবো। ইতোমধ্যেই রাজধানীসহ জেলা শহরে উন্নয়ন শোভাযাত্রা হয়েছে। আমাদের দলের প্রচার সম্পাদকের নেতৃত্বে টিম আছে। সেই টিম বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই একটি বুকলেট করেছে। বুকলেট আমাদের হাতে হাতে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কপি করে করে একদম মাঠ পর্যায়ের এটি পৌঁছাবো আমরা। সেটিও আমরা প্রচার করছি। কিভাবে এই প্রচারণা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে কাজ চলছে। এছাড়াও প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিছু উন্নয়ন চিত্র যাবে, রাস্তায় বিলবোর্ড আকারে যাবে, সেই সাথে আরও কিভাবে কাজ করতে হবে সেসব নিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রচার সেল থেকে নির্দেশনা দেবে। আওয়ামী লীগ সরকারের এতো উন্নয়ন হয়েছে যে যেকোনো মানুষ দেখলে অনেক প্রশংসা করেন বলে জানান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি ধারাবাহিক সরকারের বড় সাফল্য হলো তাদের কর্মকান্ড তুলে ধরা। এক্ষেত্রে তিনবারের আওয়ামী লীগ সরকার অনেক দলের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকে। আগের সরকারগুলো তাদের সময়ের উন্নয়ন সেভাবে সামনে আনতে পারে না। কারণ, সেগুলো পুরনো। মানুষ নতুনত্ব চায়। বর্তমান সরকার দেখাচ্ছে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, টানেল। ফলে উন্নয়ন যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনি এর কিছু সুফল মানুষ পাচ্ছে। এ কারণে নির্বাচনে দলও একটা ভালো মেসেজ দিতে পারে। এটা একটা দলের বাড়তি সুবিধা।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, চলতি বছরেই ভোটের আগে খুলে দেয়া হবে কয়েকটি প্রকল্প। গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এর সুফল পাচ্ছে। বরিশাল ভোলার মানুষ এখন দিনে দিনে রাজধানী ঘুরে ফিরে যেতে পারছেন। এক অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এই সেতুকে ঘিরে। এছাড়াও উত্তরা থেকে থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু করা হয় গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর। এই বছরেই এর মতিঝিল পর্যন্ত চালু করা হবে। ইতোমধ্যে এ অংশে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে টানেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল সেপ্টেম্বরে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। এটিই হবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম টানেল। এ প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, একই মাসে ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি রেলসংযোগও চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এতে করে পর্যটকসহ সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত ব্যবস্থা আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
গত ৮ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প পরিদর্শন শেষে তিনি ওবায়দুল কাদের আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও হয়ে ফার্মগেট র্যাম্প পর্যন্ত যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এই অংশটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকার যে উন্নয়ন করেছে ৩ টার্ম ধরে সেটি অবশ্যই একটি অভূতপূর্ব। দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। বিষয়টি হচ্ছে যে উন্নয়ন নিয়ে নানাকেন্দ্রীক ষড়যন্ত্রও আছে। ষড়যন্ত্রের জবাবগুলো সাধারণত প্রচার বা দৃশ্যমান করার মধ্য দিয়ে দিতে হবে। আওয়ামী লীগ তার উন্নয়ন কর্মকান্ড কতোটা প্রচার করছে বা করতে পারবে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে উপস্থাপন করলে ভোটব্যাংক নিজেদের অনুকূলে রাখতে পারবে।
ঢাবির সহকারী অধ্যাপক আরও বলেন, এটি ঠিক তিন টার্মে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে, সেটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। যেটি স্বাধীনতা পরে এইভাবে অর্থনীতিক সামাজিকভাবে অন্যকোনো সরকার করেনি। এটা আওয়ামী লীগের জন্য ইতিবাচক। তবে আওয়ামী লীগ যা করে সেটি সবসময় শৃঙ্খলার সাথে উপস্থাপন করতে পারেনা। দেশের জন্য মানুষের জন্য যে কাজগুলো করে আওয়ামী লীগ সেগুলো শৃঙ্খলার সাথে বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে দলটির একটি কৌশলগত ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি। এসব ঘাটতি কমানো গেলে দিনশেষে দলেরই লাভ।
উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে আসছে অক্টোবরে চালু হতে যাচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের একাংশ। এ টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত লন্ডনের হিথ্রো, নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি, সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি, আরব আমিরাতের দুবাই বিমানবন্দরের আদলে। এ টার্মিনাল পুরোদমে চালু হলে এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল বাংলাদেশের সংকেত বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হবে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প। যার মাধ্যমে আরেকটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটবে বাঙালি জাতির। পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন রেলসেতুর কাজও প্রায় শেষ। বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত চলমান প্রকল্প বিআরটির এক প্রান্ত খুলে দেওয়া হবে যান চলাচলের জন্য। চলতি বছরের মধ্যে খুলছে বিআরটির অন্য অংশও। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি খুলছে সেপ্টেম্বরে, যার মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
সড়ক পথে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ঢাকা-টাঙ্গাইল ৪ লেন মানুষের দুর্ভোগ কমিয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে গাজীপুরে একাধিক সড়ক খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রথম ৬ লেনের কালনা সেতুর উদ্বোধন হওয়াতে যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, মাগুরাসহ পাশের জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে গেছে। খুব সহজেই রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যাতায়াত করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়নও রয়েছে। দেশের উপজেলায় হাসপাতালে বেড বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি জেলা হাসপাতালকে ২৫০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। আধুনিক মানের চিকিৎসা ইনস্টিটিউট, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। এতে প্রচুর লোকবল বাড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ এসব প্রচার করতে চায় সারাদেশজুড়ে। সারাদেশে গৃহহীনদের ঘর করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। সেটিও এক বিরাট সাফল্য হিসেবে সামনে নিয়ে আসছে দলের নেতাকর্মীরা। এতে সারাদেশের ভূমিহীন মানুষরা সুফল পেয়েছেন।
এর আগে, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী জানান, জনকল্যাণমুখী রাজনীতি করে আওয়ামী লীগ। দেশের সব সোনালি অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা চিন্তা করে। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় আওয়ামী লীগ। দেশের যে উন্নয়ন এই সরকার করেছে আগামীতেও দেশের জনগণ এই দলের প্রতি ভরসা রাখবে।
সম্প্রতি শান্তি সমাবেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেছেন, দেশে শান্তি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আমাদেরকে এই বিশাল শান্তি সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ জেগে উঠেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলছে। বিভিন্ন সোস্যাল মাধ্যম, বিলবোর্ডসহ বিভিন্ন ভাবে সরকারের নানামুখী উন্নয়ন প্রচার সামনে আরও বাড়বে বলেও জানান একাধিক আওয়ামী লীগের নেতা। তারা বলেন, তারা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চায়। জনগণের কাছে উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে সেটি ফলাও করে নির্বাচন পর্যন্ত দুয়ারে দুয়ারে প্রচার চালাবে। সাধারণ মানুষ উন্নয়নের পক্ষেই রায় দেবে বলেও প্রত্যাশা করেন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা।
ডব্লিউএইচ/এমএইচটি