গেল ১২ জুন ‘ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস’। ভূমিকম্পের সার্বিক প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দিবসটি পালন করা হয়। পৃথিবীতে ভূমিকম্পের তীব্রতা সব স্থানে সমান নয়। যেমন: জাপানে সব থেকে বেশি ভূমিকম্প হয়ে থাকে। দেশটির মেটেওরোজিক্যাল এজেন্সি বলছে— প্রতি বছরে দেড় হাজার ভূমিকম্প হয় জাপানে। এই বছরের প্রথমে তুরস্ক–সিরিয়াতে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে যেখানে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের কাছাকাছি কোনো মহাসাগর না থাকায় সামুদ্রিক ভূমিকম্পপ্রবণ হিসেবে ধরা না হলেও ভূমির গঠনগত কারণে বাংলাদের রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাঝারি এবং খুলনা অঞ্চল কম ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়। ভূতত্ত্ববিদরা বাংলাদেশের উত্তরে আসাম, হিমালয় ও বঙ্গোপসাগরে তদলেশে ভূমিকম্পের প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী শহর। ৪০০ বছরের পুরাতন এই শহরে আয়াতনের থেকে জনসংখ্যা বেশি। ঢাকা শহরের জনসংখ্যার সাথে বছরে প্রায় ৬ লাখ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। কারণ দেশের বিভিন্ন যায়গায় থেকে মানুষ কর্মসংস্থান, ব্যবসা, চিকিৎসা, শিক্ষাগ্রহণসহ নানা কাজে শহরে আসছেন।
বিবিএস ও ইউএনএফপিএ’র তথ্যমতে— ঢাকা মেগাসিটি দেশের সবচেয়ে বড় পুঞ্জীভূত নগর এলাকা। দেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ এই মেগাসিটিতে বাস করে। ফলে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে। গাছা পালা কেটে ও জলাশয় ভরাট করে নতুন নতুন বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১১ বছরে ২৫ শতাংশ হারে ঢাকা শহরে বহুতল ভবন বেড়েছে। একই সঙ্গে জলাশয় ও সবুজায়ন কমে গেছে। অধিকাংশ ভবননির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। সামনে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা, অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত তলা’র থেকে বেশি তলা বিল্ডিং নির্মাণ, নকশার ত্রুটিসহ নানা বিষয় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে, পুরাতন ঢাকার জরাজীর্ণ বিল্ডিং ও জলাশয়ের ওপর বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি ভবন বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ঢাকা শহর ভূমিকম্পের বিধ্বস্ত রূপ এখনো দেখেনি। কিন্তু গবেষকদের ধারণা, ঢাকার আশপাশে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে এই শহর। জাতিসংঘের তথ্যমতে— পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা শহর আছে। বিগত বছরের বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়।
যে ধরনের প্রস্তুতি রাখতে হবে
কার্যকারী পদক্ষেপ না নিলে দুর্যোগের মুহূর্তে ও আগে পরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। এমনকি উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হবে। ফলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিজ্ঞাপন
প্রথমত, দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে রাজউকে আরও শক্তিশালী করে নিয়মিত তদারকি করতে হবে যাতে বিল্ডিং কোড ও নকশার বাইরে কোনোভাবেই ভবন না নির্মাণ করা হয়। জলাশয় ভরাট পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে এবং বিল্ডিংয়ের সামনে উন্মুক্ত স্থান ও প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করতে হবে। যারা আইন অমান্য করবে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দুর্যোগ পূর্ববর্তী, সংগঠিত সময় ও পরবর্তীতে করণীয় সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পুরাতন ও ত্রুতিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা ও সংস্করণ করা, পরামর্শ সেল গঠন এবং নদী ও খাল দখল মুক্ত রাখতে হবে। উদ্ধার কার্যক্রমের পর্যাপ্ত সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে রাখা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং স্বেচ্ছাসেবীদের ট্রেনিং দেওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও বাসা বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসার উপকরণ এবং হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও ওষুধের ব্যবস্থা রাখা।
দ্বিতীয়ত, দুর্যোগের সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া। তৃতীয়ত, দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কাজ চালানো, আহতদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। বিমানবন্দর ও সেনবাহিনীকে বিদেশের সহায়তা ও উদ্ধার তৎপরতায় কাজে লাগাতে প্রস্তুত রাখা।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের ব্যবস্থা, বাড়িতে শুকনো খাবার ব্লেড, টর্চ লাইট রাখা এবং পরস্পরের সহযোগিতা করাসহ সার্বিকভাবে সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে যথাযথ পদক্ষেপের নিতে হবে। কারণ সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের অভাবে মাঝারি বা অতিমাত্রার ভূমিকম্প ঢাকা শহরকে মৃত্যুস্তূপে পরিণত করতে পারে।
লেখক, সামিয়া চাঁদ, শিক্ষক, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা।
মো. শাহিন রেজা, সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

