বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সনদ পোড়ানো বনাম আমাদের উচ্চশিক্ষা!

খালিদ হাসান রাতুল
প্রকাশিত: ০২ জুন ২০২৩, ১২:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

সনদ পোড়ানো বনাম আমাদের উচ্চশিক্ষা!

বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে একটি ভিডিও—উচ্চশিক্ষিত এক তরুণী তার সার্টিফিকেট পোড়াচ্ছেন। ভাইরাল সেই ভিডিও নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। মূলত সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাওয়ার হতাশা থেকেই শিক্ষা সনদ পুড়িয়েছেন তিনি। ফেসবুকের কল্যাণে সবার কাছে সার্টিফিকেট পোড়ানোর ঘটনাটি পৌঁছে যায়। গণমাধ্যমের খবরে টনক নড়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের। অবশ্য সেই তরুণীর ভাগ্যও ছিল সুপ্রসন্ন। সার্টিফিকেট পোড়ানোর বদৌলতে তিনি পেয়ে গেলেন সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণ।  

এদিকে গত মঙ্গলবার (৩০ মে) নিজের সব অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলেছেন আব্দুস সালাম নামে ঢাকা কলেজের সাবেক এক শিক্ষার্থী। সেই ঘটনাটিও সবার নজরে আসে ফেসবুকের কল্যাণে। এমন ঘটনা নেহায়েত কম নয়। এর আগেও ঘটেছে অনেক। তবে কারও কপালে সরকারি চাকরি না জুটলেও ভিন্নতা ছিল ইডেন শিক্ষার্থী মুক্তা সুলতানার ক্ষেত্রে। সার্টিফিকেট পোড়ানোর এই ঘটনাগুলো মূলত প্রকাশ করে দেশের উচ্চশিক্ষা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার অসঙ্গতির কথা।


বিজ্ঞাপন


উচ্চশিক্ষিত বেকারের হারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। অর্থাৎ এদেশে তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) দুটি জরিপ অনুযায়ী, স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারীদের ৩৭ থেকে ৬৬ শতাংশ বেকার। দেশে প্রায় ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকার উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করার ফলে এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তরসহ উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন কম-বেশি সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু বিপুল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির সুযোগ আসলে কতটুকু? যেখানে কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৫ শতাংশই বেসরকারিতে। যদিও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন কারণে এই খাতেও দিনে দিনে চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। 

প্রশ্ন হচ্ছে এত সহজলভ্য উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য কী? 
উচ্চশিক্ষা মানে গবেষণাভিত্তিক পড়াশোনা, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খুব কম। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেই গবেষণার প্রবণতা। বিভিন্ন বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতে গবেষণা হয় না বললেই চলে। ফলে এত বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জায়গা করে নিতে পারছে না। পারত পক্ষে আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলো মুখস্তবিদ্যা নির্ভর সার্টিফিকেট প্রদানমুখী শিক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। পুরনো বই কিংবা নোট মুখস্থ করে পরীক্ষায় তা লেখাও এক ধরনের একাডেমিক ‘চৌর্যবৃত্তি’। এতে বিদ্যার চর্চা তথা চৌর্যবৃত্তি দেশের উন্নয়নের কিংবা নতুনত্ব সৃষ্টির সবচেয়ে বড় অন্তরায়। কিন্তু শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার বাড়ানোর পরিসংখ্যানে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে সরকার। 

মূলত উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম মানদণ্ড আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। ফলে প্রতিবছরই বাড়ছে আমাদের বেকারের সংখ্যা। দেশীয় বিশ্ববিদ্যালগুলোর ক্যারিকুলামের সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরনের সঙ্গে কোনো মিল না থাকায় চাকরি ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন, টেকনিক্যাল ও বিষয়ভিত্তিক যে দক্ষতা থাকা দরকার তা নেই তরুণদের মাঝে। এতে দক্ষতা ও কাজ জানাদের অগ্রাধিকার দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে বেকার তৈরি হচ্ছে দিনকে দিন। প্রসঙ্গত, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের গ্রাজুয়েটরা যখন পৃথিবীর বৃহৎ আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন বাংলাদেশের আইটি গ্রাজুয়েটরা চাকরির স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে।


বিজ্ঞাপন


দেশে বেকারত্বের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে স্নাতক (অনার্স) শেষ করার পর একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী কোনো ধরনের কাজ শুরু না করে বিসিএস বা সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের বড় অংশ চাকরির বয়স শেষ হওয়া পর্যন্ত চাকরির জন্য বিভিন্ন সাধারণ জ্ঞান ও বাংলা, ইংরেজি সাহিত্য ও বিবিধ বিষয় এ প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করছে। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ কোনো সরকারি চাকরি না পেয়ে চাকরির বয়স শেষ করে বিপাকে পড়ছে। এত বড় একটি সময় অতিবাহিত করার পর কোনো বেসরকারি চাকরি বা বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে তারা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি এত অধিক সংখ্যক শিক্ষিত বেকার হওয়ার সুযোগে অনেক প্রতিষ্ঠান খুব কম বেতনে চাকরির অফার করছে, যা কিনা জীবনধারণের ন্যূনতম ব্যয় মিটানো সম্ভব হয় না। 

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো নির্ধারিত বেতন স্কেল নেই এবং চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হয়, তাই তরুণরা সরকারি চাকরিতে বেশি মনযোগী। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার জন্য জীবনের একটি বড় সময়, অনেক অর্থ ব্যয় হয় এবং সমাজ, পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি ভালো কিছু করার তাড়না দেওয়া হয়। যখন সেই উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট বা পড়াশোনা তার কর্মজীবনে কোনো কাজে আসে না তখন তাদের শিক্ষাজীবনের অর্জিত সার্টিফিকেট তাদের কাছে বোঝা মনে হয়। ফলে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ফলাফলস্বরূপ বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং বেশ কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বাংলাদেশ এখন ডেমগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এই অবস্থান করছে অর্থাৎ বর্তমানে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। এই বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীকে সঠিক দক্ষতাসম্পন্ন করে মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার সুযোগ আছে। উচ্চশিক্ষার সংখ্যার চেয়ে যুগোপযোগী মানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত নতুবা উচ্চশিক্ষাই হবে উচ্চ বেকারত্বের কারণ!

খালিদ হাসান রাতুল
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, মানবসম্পদ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান
সাবেক শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর