মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বিদ্রোহী কবিতা ও রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২৫ মে ২০২৩, ০৬:১০ এএম

শেয়ার করুন:

বিদ্রোহী কবিতা ও রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক

ছোটবেলা থেকেই নজরুলের হৃদয় ছিল দুঃখ ও যন্ত্রণার। ভূমিষ্ট হয়েছিলেন যে গৃহে সেটি ছিল খড় দিয়ে ছাওয়া এবং মাটির তৈরি। নয় বছর বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। পিতার নাম কাজী ফকীর আহমদ। নজরুলের ডাক নাম দুখু মিয়া। কারণ, জীবিকার জন্য শৈশবেই নজরুলকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। মসজিদের মোয়াজ্জিন, দরগার মোতাল্লির কাজ তিনি করেছেন। পালা গানের দলে যোগ দিয়েছিলেন। রুটির দোকানে চাকরি করেছেন। মানুষের বাড়িতে কাজ করেছেন। সুখ কি জিনিস তার ভাগ্যে জোটেনি। এত দুঃখের পরও তিনি চালিয়ে গেছেন লেখালেখি। লেখেছেন বিদ্রোহী কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস। বিদ্রোহী কবিতা কাজী নজরুল ইসলাম এর বিখ্যাত কবিতাগুলোর একটি।

যদি এক কথায় বলি তাহলে, কাজী নজরুল ইসলাম সবসময় অন্যায়, অবিচার এসবের বিরুদ্ধে যে সাহস নিয়ে লিখেছেন, যেভাবে তার লিখনির মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, অন্য কোন কবি এভাবে প্রতিবাদ করেনি, তাই কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি। অর্থাৎ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার রচনাকাল ছিল সারা পৃথিবীর জন্য অস্থির সময়। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে, শৃঙ্খলপরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। এই কবিতা রচনার জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী কবির আখ্যা পেয়েছেন। খেটেছেন জেলেও।


বিজ্ঞাপন


কবি লর্ড বায়রন বলেছেন, ‘এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি।’ ১৮১২ সালে ‘চাইল্ড হ্যারল্ডস পিলগ্রিমেজ’ কবিতাটি প্রকাশের পর কবি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে এ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন বিস্মিত বায়রন। বাংলা সাহিত্যে ঠিক এ রকমই ঘটনা ঘটেছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় কবিতাটি মুদ্রিত হলে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ১৩২৮ সংখ্যায় এটি ছাপা হয়েছিল। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ‘প্রবাসী’, ‘সাধনা’, ‘ধূমকেতু’ ও দৈনিক ‘বসুমতী’সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় কবিতাটির পুনর্মুদ্রণ হয় যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়। একই কবিতা এত বেশিসংখ্যক পত্রপত্রিকায় প্রকাশের ঘটনাও সম্ভবত এটিই প্রথম।

লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে অসম্মান ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো মানুষের সাহসের উচ্চারণ হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী কবি নজরুল। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আমাদের জাগরণের স্মারক। কালজয়ী কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। সেই হিসাবে এখন ধ্রুপদি এ কবিতার শতবর্ষ। এমনি এক মুহূর্তে পরাধীন দেশের সময়ের প্রয়োজনে কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করলেন তার অমর কবিতাখানি, যে কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতি পেল বিদ্রোহের নতুন ভাষা। যুদ্ধ জয়ের নেশায় উন্মত্ত হলো আবাল বৃদ্ধবনিতা। আত্মবিশ্বাসের অভাবে যে জাতির চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস ছিল না, যে জাতি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বিনা প্রতিরোধে স্বাধীনতা হারিয়েছিল, সেই জাতি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে অসীম আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। কবিকণ্ঠের দৃপ্ত উচ্চারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভারতবাসী গেয়ে উঠল- ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমারে খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’

নজরুলের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, ছিল না স্থায়ী বাসগৃহও। নজরুলের ছয়টি বই ছিল নিষিদ্ধ। অভাবের কারণে কোনো কোনো বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। নজরুল ছিলেন উদ্বাস্তু। নজরুলের না ছিল দক্ষতা না আগ্রহ। শখ করে একসময় তিনি একটি মোটরগাড়ি কিনেছিলেন, কিন্তু রাখতে পারেননি। কবিতা ও গদ্য চর্চা ছেড়ে নজরুল যে একসময়ে পুরোপুরি গানের জগতে চলে গিয়েছিলেন তার পেছনেও অর্থনৈতিক কারণ ছিল। এক সময়ে রেকর্ডের দোকান খুলবেন ভেবেছিলেন, উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু সফল হননি। নজরুল তো চুপ হয়ে গেলেন ১৯৪২-এ এসেই। চুপ হয়ে যাননি, আসলে তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনও মন্তব্য করা হয়েছিল যে বিদ্রোহী কবি রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেটাও সত্য নয়। ক্লান্ত হননি, দাবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শত্রুপক্ষের ভেতরে প্রথম ছিল ব্রিটিশ রাষ্ট্র। হেন নির্যাতন নাই রাষ্ট্র যা নজরুলের ওপর চালায়নি।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ক্ষেত্রে বিস্তর মিল আছে। দুইজনই কবি। দুইজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল মধুর সম্পর্ক। আসলে রসের রসিক না হলে সব সম্পর্কের রসায়ন উন্মোচন হয় না। নজরুল-রবীন্দ্রনাথের এই চিরায়ত মধুর সম্পর্ক সম্পর্কে বিন্দু-বিসর্গ না জেনেই অর্ধশিক্ষিত বাঙালি সমাজ নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালায়, তাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করে, উভয়কে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার নিক্তিতে মেপে দ্বিখণ্ডিত করে। কখনো বা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনে তাদের দু’জনকে শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে যারা সত্যিকার অর্থেই জেনেছে, বুঝেছেন, ধারণ করতে পেরেছেন, তারা স্বীকার করবেন প্রকৃত অর্থেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ছিল অপরিমেয়, অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অতল শ্রদ্ধা। তাদের মধ্যে শত্রুতা তো দূরে থাকুক, মনোমালিন্যও কোনো দিন হয়নি। দানবীয় প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ নিজের সারা জীবনের সুপ্ত শক্তির সাকাররূপ নজরুলের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছেন, পাশে বসিয়েছেন, স্নেহ-শাসনে নজরুলের জীবন পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন কানায় কানায়। এরপর থেকে তাদের উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ, চিঠি-পত্র আদান-প্রদান হতো নিয়মিত। চিঠি-পত্রে এবং ব্যক্তিগত সম্বোধনে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুজি’ বলতেন।


বিজ্ঞাপন


নজরুল একদিন বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তার বিদ্রোহে একদিন জগৎ আলোকিত হবে, রবীন্দ্রনাথের তা জানা ছিল। তা নাহলে এই চাল চুলোহীন, অর্ধশিক্ষিত, গোয়ার, বোহেমিয়ান যুবককে অত্যধিক স্নেহ-যত্ন করবেন কেন রবীন্দ্রনাথ? তিনি নজরুলের মধ্যে আবিষ্কার করেছিলেন নির্ভীক ব্যক্তিত্ব, অনমনীয় আত্মপ্রত্যয়, দুর্জয় অহংবোধ এবং অবিসংবাদিত দেশপ্রেম।

৭ জানুয়ারি, ১৯২২। সকাল বেলা ‘বিজলী’ পত্রিকার চারটি কপি হাতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সামনে হাজির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি, গুরুজি’ বলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিমায় চিৎকার করছেন নজরুল। শান্ত ও ধ্যান গম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে অমন করে চিৎকার করা বা বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে চেঁচানো কারও সাহস ছিল, কিন্তু নজরুল স্বভাবসুলভ আচরণে সেদিন তা করে দেখিয়েছিলেন। অথচ জোড়াসাঁকো পুরো বাড়িটাই ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর আর রমণীয়। বাঘা বাঘা লোক, পণ্ডিত-মনীষী সংযতভাবে ওই বাড়িতে ঢুকতেন, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলার সময়। কেউ কখনো একটু সময়ের জন্যও অসংলগ্ন আচরণ করতেন না। চিৎকার চেঁচামেচি তো দূরের কথা।

নজরুল সেদিন ঠাকুর বাড়ির এই শান্ত সমাহিত নীরব পরিবেশ ভঙ্গ করে অকম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করে গুরুজি, আপনাকে হত্যা করব, বলে মহাহুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ একটু বিরক্ত বা বিব্রতবোধ হননি, বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হননি। তাই নজরুলের এসব উৎপাত রবীন্দ্রনাথ সব সময় সহ্য করেছেন, মেনে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বাড়ির দোতলা থেকে বললেন, ‘কি হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন? এসো, উপরে এসে বসো?’ এবার ‘বিজলী’ পত্রিকা হাতে উপরে উঠলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় বিদ্রোহী কবিতাটি শুনিয়ে দিলেন- যা আগের দিন ছাপা হয়েছে বিজলী পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে এতক্ষণ শুনছিলেন, স্তব্ধ হয়ে নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবি নজরুলকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, কাজী, তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতার জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’

সবদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ব্যবধানটা ছিল বিস্তর। আসলে নজরুলের মতো অবস্থা থেকে এর আগে বা পরে বাংলা সাহিত্যে অত বড় মাপের কোনো কবির অভ্যুদয় ঘটেনি। এ বিষয়টির স্বীকৃতি প্রথম রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন নজরুল। সেই স্বীকৃতির প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৯২২ সালের ৭ জানুয়ারি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের আনন্দে উদ্বেলিত নজরুলকে বুকে টেনে নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবির স্বীকৃতি দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রাণ ও গানের কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন, বলেছেন নজরুলও; গান না থাকলে বুঝতে হবে প্রাণ নেই। আজকের পৃথিবীতে ধ্বনি আছে বহু, আছে হুঙ্কার ও আর্তনাদ, অভাব গানের। গানের ফেরত আসা চাই; কিন্তু সে তো আসবে না প্রাণ যদি শক্তিশালী না হয়। প্রাণ বাঁচানোর সংগ্রামে বিশ্বকে ব্যক্তি মালিকানার বৃত্ত থেকে সামাজিক মালিকানার স্তরে নিয়ে যাওয়ার কাজ করাটাই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরের দিন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্র-নজরুলের যে ‘মহামিলন’ সেটিই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ নয়। এর সাড়ে পাঁচ মাস আগে অর্থাৎ ১৯২১ সালের ২০ জুলাই ওই জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতেই তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল জীবনীকারদের বর্ণনায় এমনটিই উঠে এসেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর