শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

যুগের নাম ‘শেখ হাসিনা যুগ’

শেখ স্বাধীন শাহেদ
প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২৩, ০৫:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

যুগের নাম ‘শেখ হাসিনা যুগ’

১৯৬৫ সাল। নতুন গঠন করা Board of Intermediate and Secondary education,East Pakistan এর অধীন ম্যাট্রিক পরীক্ষা চলছে। কেন্দ্রের কড়াকড়ি তো ছিলই, ছিল সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অধিকার। ব্রিটিশদের দেখাদেখি পাকিস্তানের পরীক্ষকরাও শিক্ষার্থীরা কেউ প্রথম শ্রেণির লেখা লিখতে পারে, তা বিশ্বাস করতেন না। বরং ফেলের সংখ্যাটা এত বেশি যে, কেউ ম্যাট্রিক পাস করলে লোকজন তাকে দেখতে আসত। সবগুলো প্রশ্ন সঠিক লিখে আসতে পারলেই কেবল বুকে বল রাখা যেত যে, ৪০ পাওয়া যাবে। একটা প্রশ্ন লিখতে না পারলেই আর ভরসা করা যেত না। পরীক্ষকের কৃপা আর সৃষ্টিকর্তার অনুকম্পা- এই দুইয়ের নিক্তিতে ঝুলে থাকত পরীক্ষার্থীর পাস-ফেল। এমন এক সময় সমাজ বিজ্ঞান পরীক্ষায় পাকিস্তান বিষয়ে ছিল কুড়ি নাম্বার। যেখানে একটা প্রশ্ন ছাড়লে ফেল করার সমূহ আশঙ্কা থাকে, সেখানে সম্পূর্ণ কুড়ি নাম্বার না লেখা একজন পরীক্ষার্থীর কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন যিনি এবং কৃতিত্বের সাথে পাস করেছিলেন, তিনিই শেখ হাসিনা। জনকের কন্যা, আমাদের দেশরত্ন।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সে দুর্দমনীয় সাহস তা তিনি পেয়েছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে, তাঁর বাবার গল্প শুনে শুনে। ক্রমে বিপদ এসেছে আর তা মোকাবেলা করে তিনি হয়েছেন আরও সাহসী। দুঃসাহসিক না হলে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তাকে যখন ইউরোপ থেকে এক অর্থে রিফুজি করে বিতাড়িত করা হয়, তখনই তিনি নিঃশেষ হয়ে যেতেন। তার কাছে মাত্র ৩০ ডলার, তার স্বামী চাকরিহীন! এই অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি এলেন ভারতে। ইন্ডিয়াগেট সংলগ্ন পান্ডারা রোডের একটি ফ্ল্যাটে বাংলাদেশের জনকের কন্যার ঠাঁই হলো! দুটি বেডরুম, একটি ড্রয়িংরুম। দেশ-বিদেশের খবর শোনার জন্য একটি ট্রানজিস্টার! আর শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া ভাতা পেতেন ৬২ রুপি! এইতো বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির মেয়ের জীবন। সেনাবাহিনী রুম বুঝিয়ে দেবার সময় আরও তিনটা ‘সম্বল’ দিয়ে যায় চলে যাওয়ার সময়। (১) কারো কাছে পরিচয় না দেওয়া, (২) বাইরে বের না হওয়া, (৩) দিল্লির সাথে যোগাযোগ না করা! আহারে জীবন! আহা জীবন।


বিজ্ঞাপন


জীবন আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে যখন ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর অন্যান্য কাজগুলোর মতো শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়াও ভালোভাবে নেননি। অলিখিতভাবে তাকে বলে দেওয়া হলো, চলে যাও, ভারতে তোমাদের থাকা হবে না! বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করে দিল মোরারজি সরকার। গাড়ির সুবিধা তুলে নিল। একই সময়ে বাংলাদেশে চলছে আওয়ামী লীগকে ‘আমলীগ’ করার হীন পাঁয়তারা। মুশতাকের সঙ্গে জেনারেল ওসমানী আওয়ামী লীগের মোড়কে পাকিস্তানি দোসরদের সহযোগিতা করছেন। জেলের মধ্যেই খুন হলেন জাতীয় চারনেতা। অন্য যারা ছিলেন, সবার নামেই হুলিয়া জারি হলো। দেশে থাকতে পারলেন না কেউই। যারা ছিলেন তারা রাজনীতির সাথে থাকতে পারেননি। থেকেছেন ঝাড়জঙ্গলে অথবা বন-বাদারে পালিয়ে। মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগকে নিয়ে ব্যবসা করলেন। কেউ না থাকায় নিজেই কমিটি করেন, নিজেই ভাঙেন। জিয়াউর রহমান জানিয়ে দিলেন- শেখ মুজিবের নামের আগে বঙ্গবন্ধু থাকলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। সাজেদা চৌধুরীরা তা মানেননি। বরং সাজেদা চৌধুরী প্রস্তাব করলেন- শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে এনে আওয়ামী লীগের সভাপতি করার। সেখানেও বাধা এলো। মিজানুর রহমানরা তো ক্ষমতার লোভেই এই সিদ্ধান্ত মানলেন না। অন্যান্য যারা তারা বললেন- ও বাচ্চা মেয়ে! ওকি পারবে? সাজেদা চৌধুরীর জবাব ছিল- ‘বাচ্চা হলেও বাঘের বাচ্চা।’ (উত্তরণ, জুন,২০১৪)।

স্বয়ং এম ওয়াজেদ আলী তার ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের প্রতিহিংসার রাজনীতিতে নিজের পত্নীকে জড়াতে দিতে চাননি। চাননি ইন্দিরা গান্ধীও বঙ্গবন্ধু তনয়ার নিরাপত্তার কথা ভেবে। সাজেদা চৌধুরীকে সাফ জানিয়ে দিলেন- "Not now.By time will come.I will say,not now"। ইন্দিরা গান্ধী এবং ওয়াজেদ আলীর শঙ্কা অমূলক ছিল না। কারণ ইতোমধ্যেই জিয়া তার "I will make politics difficult for the politicians " কাজে শতভাগ সফল হয়েছিলেন।

আর এত প্রতিকূলতার মাঝে বাঙালির আশার শেষ বাতিঘর শেখ হাসিনার জবাব ছিল এমন- ‘পার্টিই যদি ভেঙে যায় তাহলে আমি পরের দেশে গিয়ে কী করব। হয় এখন, না হয় কখনোই না।’ বিদেশে থাকা অবস্থাই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়। শেখ হাসিনাকে করা হয় সভাপতি। শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি তাঁর বাবার রেখে যাওয়া স্বপ্নকে পূরণ করতে এলেন প্রিয় বাংলাদেশে। জিয়ার কড়া প্রহরা, সেনাশাসনের রক্তচক্ষু, আওয়ামী লীগের নামে জিয়ার দোসরদের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে সেদিন বৃষ্টিস্নাত ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। আবাল বৃদ্ধা বনিতা, হিন্দু মুসলিম খ্রিষ্টান, কোটিপতি থেকে রাস্তার ফকির সবাই সেদিন তাদের ‘হাসু আপাকে’ স্বাগতম জানান। আর সবার অন্তরালে প্রিয় ‘হাসু আপা’ বৃষ্টির জলে নিজের চোখের পানি যেন  লুকিয়েছিলেন।

সেই যে শুরু, তারপর তার সামনে যে বাধাই এসেছে, তাকে তিনি জয় করেছেন। তাকে তো মেরেই ফেলার চক্রান্ত হয়েছে ২০ বারের বেশি! গণতন্ত্র উদ্ধার করার সংগ্রামে নির্যাতিত হয়েছেন। ১৯৯১ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর দল ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে আবার। তিনি অটুট ছিলেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি প্রহসনের নির্বাচন করলে, কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়েন। শেখ হাসিনা লড়াই করেছেন। ২০০৪ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য হামলায় তাকে মৃত্যুর কোল থেকে এদেশের মানুষের দোয়াই কেবল ফিরিয়ে এনেছিল। তিনি তারপরেও ভয়ে চুপসে যাননি।


বিজ্ঞাপন


২০০৭ সালে সেনাশাসনে সময় তিনি কানাডা অবস্থান করছিলেন। তার দেশের ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। তিনি আলজাজিরা টেলিভিশন মারফত এদেশের ১৪ কোটি জনগণকে জানিয়ে দিলেন ‘বাংলাদেশে আমার জন্ম, ওই মাটিতেই আমার মৃত্যু হবে। কোনো হুমকিই আমাকে দেশে ফেরা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।’ তিনি দুরধিগম্য। সব বাধা ভেঙে দেশে এলেন আজকের এই দিনে। কেউ তাকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি তৈরি হয়নি যে শেখ হাসিয়াকে ভয় দেখাতে পারে। আমেরিকার কথাই বলি। আমেরিকার একটা সাধারণ র‍্যাপার গায়ক যদি র‍্যাপের সাথে বাংলাদেশকে হুমকি দেয়, এদেশের বহু লোক আছে যারা ভয়ে চুপসে গেছে। যখন দেশের আইন অমান্য করে জোরপূর্বক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান রাখা হয়, তখন বহুবার আন্দালিব রহমান পার্থসহ এদেশের বহু নেতা ভয়ে প্যান্ট ভেজাতেন। অনেক টিভি শোতে তারা তা বলতেনও। এক টিভি শোতে পার্থ বলছিলেন- ‘আমার ফোনে সর্বোচ্চ খালেদা জিয়ার ফোন আসে। আর ইউনূসের ফোনে হিলারি ক্লিনটনের কল আসে।’ সেই হিলারি ২০১১ সালে ১৬ জানুয়ারি যখন ইউনূসের পক্ষ থেকে ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সুপারিশ করতে টেলিফোন করেন তখন এ প্রান্ত থেকে শেখ হাসিনার স্পষ্ট জবাব- ‘এটা আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আপনি চিন্তিত হবেন না।’ কোন পর্যায়ের কঠিনীকৃত মানসিকতা থাকলে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এভাবে কেউ উত্তর দিতে পারে, তা নিয়ে একদিন গবেষণা হবে।

সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল শেখ হাসিনার দিকে, তারও পর যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন পদ্মা সেতু হবে নিজেদের টাকায়। সারা বিশ্ব একদিক তিনি অদম্য একদিক। বিশ্বব্যাংক মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। বিশ্বব্যাংক ঘুরল ৯০ ডিগ্রি, তিনি ১৮০ ডিগ্রি। কোনো কোনো বিশ্বনেতা বলে বসলেন- বাংলাদেশ আবার তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হতে চলেছে। এদেশের জ্ঞানপাপীরা বলল- ধ্বংস হয়ে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ফখরুলরা বললেন- পিলারও বসবে না! আরও কত কী? কিন্তু বাস্তবে আজ আমরা কী দেখছি। পদ্মা সেতুও হচ্ছে, আমাদের জিডিপিও ৭.৭! আমরা একই বছর হেফাজতে মতো উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দেখি। আমরা দেখেছি এরশাদ চাচা পানি এগিয়ে দিয়েছেন তাদের, খালেদা ম্যাডাম মদদ দিয়েছেন তাদের। এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী জোট শেষ পর্যন্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা,পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে তো নালিশ করেছেই। কিন্তু ন্যায় এবং সাংবিধানিক পবিত্রতা রক্ষায় শেখ হাসিনাকে কেউ টলাতে পারেনি। একই ধারাবাহিতা আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার সময়েও। পাকিস্তান তার এদেশীয়  বাচ্চা-কাচ্চাদের বাঁচাতে মায়াকান্না শুরু করল। পাকিস্তানের দোসর হলো তুরস্কও। তারা চিঠি পর্যন্ত লিখে থামাতে চাইল শেখের বেটিকে।

কিন্তু রক্তে যার আবহমান বাংলার সবচেয়ে সাহসী ধারা প্রবহমান তাকে ভয় দেখানো যায় না। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান এবং তুরস্কের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে জানিয়ে দেয়- ‘এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। কোনো মাতবরি বাইরে থেকে করা যাবে না।’ অন্যদিকে সেই পাকিস্তানেরই বুদ্ধিজীবীরা আজ চিৎকার করে বলছেন- ‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানাদে!’ আর তুরস্ক রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশরত্নের ভূমিকায় স্যালুট জানিয়ে গেছে মাথা নিচু করে। ঋষি সুনাক বাধ্য ছাত্রের মতো এক ধরনের জুবুথুবু হয়েই বলেন- ‘আমার মেয়েরা আপনাকে (শেখ হাসিনা) অনুসরণ করে, আপনার মতো হতে চায়।’ পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বিশ্বব্যাংকের মুখের সামনে শেখ হাসিনা সাঁটিয়ে দিয়ে আসেন পদ্মা সেতুর চিত্রকর্ম। সে সময় বিশ্বব্যাংকের এমডির মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সময় শেখ হাসিনাকে জন্ম দেয়নি। শেখ হাসিনা নিজেই নিজের একটা সময় তৈরি করেছেন। The Sheikh Hasina's Era.

লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর