শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

উত্তপ্ত ধরিত্রী, ঝড় ও মা দিবস

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ১৩ মে ২০২৩, ০৯:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

উত্তপ্ত ধরিত্রী, ঝড় ও মা দিবস

লোভী, অর্থপিপাসু মানুষই নগর-সভ্যতার পত্তনের জন্য নির্বিচারে, নিষ্ঠুরভাবে গাছপালা কেটেছে, অরণ্য ধ্বংস করেছে। কবি টেড হিউজ স্বপ্নে দেখছেন, অরণ্যের অধিকার পেতে একদল ওক গাছ কবিকে ঘিরে ধরে এবং শপথ করিয়ে নেয় যে, তিনি একটি গাছ কাটা পড়ে থাকতে দেখলে যেন দুটি গাছ লাগান। স্বপ্ন ভাঙতেই কবির চৈতন্য হয়। উপলব্ধি করেন, প্রকৃতিই তার আসল পরিবার। এখন এই মুহূর্তে আমরা বুঝতে পারছি, ক্রমবর্ধমান মানবসভ্যতায় ‘উন্নয়ন’-এর নামে দশকের পর দশক প্রকৃতিকে অবহেলা করে আজ আমরা এক ভয়াবহ বিপদে বিপর্যস্ত।

এক সময় ইংল্যান্ডে ‘শিল্প বিপ্লব’-এর মাধ্যমে যে নগর-সভ্যতার সূচনা হয়েছিল, সেই থেকে বিজ্ঞান-আশ্রিত যন্ত্র-সভ্যতা, শিল্পোৎপাদনে কলকারখানা সৃষ্টি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ এবং তার পরও যুদ্ধোত্তর আণবিক পারমাণবিক শক্তি প্রতিযোগিতা- সব মিলিয়ে পৃথিবীর পরিবেশ দূষিত করে তার স্বাভাবিকতা নষ্ট করেছি। জড় জগতের বৈভব, প্রাচুর্য, বিলাসবহুল জীবনযাত্রার মোহে আমরা মেনে নিয়েছি ‘ইটের পরে ইট, মধ্যে মানুষ কীট’ নাগরিক জীবনকে। সৃষ্টি করেছি বিশ্ব উষ্ণায়ন।


বিজ্ঞাপন


গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৪০ বছরে পৃথিবীর বন্যপ্রাণী জগৎ প্রতি দশকে প্রায় ১৭ কিমি হারে অপেক্ষাকৃত শীতল স্থানে সরে গেছে। অথচ বিগত শতাব্দীতে পরিবেশকে বাঁচাতে আমাদের দেশে মেধা পটেকরের নেতৃত্বে ‘নর্মদা বাঁচাও’, ‘জঙ্গল বাঁচাও’ আন্দোলন, সুন্দরলাল বহুগুণার নেতৃত্বে ‘চিপকো আন্দোলন’, পক্ষী-বিশারদ সেলিম আলির নেতৃত্বে ‘সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলন’ হয়েছে। বর্তমান শতাব্দীতে পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে ১৬ বছরের সুইডিশ স্কুলছাত্রী গ্রেটা থুনবার্গের ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আন্দোলন সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিন্তু, এসব সত্ত্বেও, পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানদের টনক নড়েনি। উল্টো, বিশেষ করে ‘উন্নত’ দেশগুলো ‘সুপার পাওয়ার’ হওয়ার জন্য প্রকৃতির স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করে, বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তন করে পৃথিবীকে সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

একইভাবে আমরা দেখি ধরিত্রী আমাদের মা- তার ওপরে অবিচার করলে সাগরে সৃষ্ট অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় দেখা দেয়। আইলা, সিডর, সিত্রাং হানা দেয়। তেড়ে আসে। মোকা দেশের উপকূল থেকে মাত্র ৭৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে ঝড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশে। ঝড় যত এগোবে ততই দেশের আকাশে এর প্রভাব বাড়তে থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ধরিত্রীর ওপর বারবার অত্যাচার করলে ফল ভালো হয় না। তবু ধরিত্রীর সহনীয় অবস্থা দেখে আমরা তার প্রাকৃতিক প্রতিশোধের কথা ভুলে যাই। ভুলে যাই মা দিবসের কথা।

দুই.
মা আমাদের সকলের প্রিয় শব্দ। সন্তান ভূমিষ্ঠ থেকে শুরু করে তাকে বড় করে তোলা পর্যন্ত মায়ের বিকল্প কিছু নেই। শুধু কি তাই? অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি সংসার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মায়ের বিকল্প নেই। তাই ইসলামে মায়ের সম্মান অনেক বেশি। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।

মা দিবস প্রথম উদযাপিত হয় গ্রিস ও রোমে। প্রাচীন গ্রিকরা তাদের দেবতা গ্রিককের মা রিয়ার সম্মানে উদযাপন করত বসন্ত উৎসব। ১৬ শতকে যুক্তরাজ্যে ‘মাদারিং সানেড’ নামে একটি দিবস পালিত হতো। যুক্তরাষ্ট্রে এ দিবসটি প্রচলন হয় শান্তিকামী জুলিয়া ওয়ার্ড হোর উদ্যোগে ১৮৭২ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর স্বীকৃতি ও প্রসার ঘটে ১৯১৪ সাল থেকে।


বিজ্ঞাপন


কবির ভাষায় বলা যায়- সেই যে আমার মা..., বিশ্ব ভুবন মাঝে তাহার, নেইকো তুলনা। মা.. মাগো- এর চেয়ে প্রিয় ডাক আর কি আছে দুনিয়ায়। মা আর সন্তানের মাঝেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে খাঁটি সম্পর্ক, অতীতেও ছিল এবং ভবিষ্যতে থাকবে। যদিও মাকে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা জানানোর কোনো দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না- তবুও মাকে গভীর মমতায় স্মরণ করার দিন আজ। বিশ্বজুড়ে পালন করা হচ্ছে মা দিবস।

সন্তানের প্রতির মায়ের ভালোবাসা আর মায়ের ওপর সন্তানের নির্ভরতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার থাকতে পারে না। পৃথিবীর রং-রূপ-শব্দ-গন্ধ মা-ই প্রথম চেনান-দেখান-শেখান। জগতে মায়ের মতো এমন আপনজন আর কে আছে! যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা মাকে নিয়ে রচনা করেছেন কত না বন্দনা। সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহে ফল্গুধারার হয়ে আজীবন বহমান থাকলেও চলতি জীবনের প্রযুক্তিগত যান্ত্রিক দুনিয়ায় আমরাই কেউ কেউ বুঝি না মায়ের মর্ম। এই দুনিয়াতে যাদের মা নেই শুধু তারাই বোঝে মা কি অমূল্য সম্পদ। জীবনের একপর্যায়ে মাকে তার যোগ্য সম্মান দিতে ভুলে যাই। মায়ের গভীর মমতার কথা আর তার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য মনে করিয়ে দিতেই প্রতিবছর আসে মা দিবস।

এ পৃথিবীতে মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের চেয়ে মধুর সম্পর্ক আর নেই। নদীর মতো প্রবহমান মানুষের জীবন। নদী প্রবাহ যেমন থেমে থাকে না, মানুষের জীবনও সেরকমই। জীবনের চলার পথে মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে। এ চলমান জীবনের একটি পর্যায়ে নারী এসে পুরুষের সঙ্গে বিবাহের অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে। জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। প্রেম-ভালোবাসা-সংসারের দিনযাপন আর অভিজ্ঞতার পথ বেয়ে পুরুষ হয় পিতা আর স্ত্রী হয় মা। মাতৃত্ব হচ্ছে নারীর চিরন্তন রূপ। সে মাতৃত্বের সার্বিক প্রকাশ ঘটে তার সন্তানকে লালন করার মধ্যে। যে মা সন্তানকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করেন, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অপরিসীম মায়া-মমতায় পৃথিবীর বুকে ধীরে ধীরে বড় করে তোলেন, মানুষের কোনো ভাষাতেই, কোনো কথাতেই বুঝি সেই মায়ের অবদানের পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরা যায় না। মা তো মা-ই। মার কোনো তুলনা হয় না। শ্রদ্ধা, সম্মান, ভক্তি, সেবা, ভালোবাসা দিয়ে মার দানের হয়তো কিছুটা প্রতিদান দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই মাকেই আমরা নানা কারণে অকারণে নির্যাতন করে থাকি।

একজন মা সবার জায়গা নিতে পারেন, কিন্তু কেউ তার জায়গা নিতে পারেন না। সন্তান জন্ম হওয়া থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত একজন মা কেবল তার সন্তানের জন্য বেঁচে থাকেন। একজন মায়ের দায়িত্ব অবিরাম।

মানসিক বিকাশ থেকে শুরু করে জীবনের সফলতা প্রতিটি পদক্ষেপেই মায়ের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সন্তানের জন্য সব থেকে বেশি যে আত্মত্যাগ করতে পারে সেই নামটিই হলো মা। স্বার্থপর এই দুনিয়াতে নিঃস্বার্থভাবে শুধু মা-ই আমাদের ভালোবাসতে পারেন। আমরা মাকে ভালোবাসবো, ভালোবাসবো প্রকৃতিকে- তাহলেই সুন্দর বিশ্ব গড়া সম্ভব। মাকে অবহেলা করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে একদিন কোনো না কোনোভাবে আমরা আঘাতপ্রাপ্ত হবো- সেটা বোঝা না গেলেও ধরিত্রীর প্রতিশোধ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর