শনিবার, ৪ মে, ২০২৪, ঢাকা

নগর স্বাস্থ্যে নারীর পুষ্টি

ডা. শামীম হায়দার তালুকদার ও আতিয়া রহমান
প্রকাশিত: ০৭ মে ২০২৩, ১০:৩৭ পিএম

শেয়ার করুন:

নগর স্বাস্থ্যে নারীর পুষ্টি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। দেশের বিভিন্ন উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সেবারও উন্নতি করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যের সাথে পুষ্টি সর্ম্পকযুক্ত। স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি করতে হলে অপুষ্টি দূর করতে হবে। সর্বশেষ গণশুমারির তথ্য অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এই জনসংখ্যার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৯০ হাজার ৪৬২ জন আর এর মধ্যে নগরে বসবাসকারী মহিলার সংখ্যা দুই কোটি ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৪ জন [১]। আমাদের দেশে বিভিন্ন বয়স এবং বিভিন্ন পেশার মহিলা রয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মহিলা অপুষ্টিতে ভোগে [২]।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পুষ্টি স্বাস্থ্য উন্নয়নের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ। উন্নত পুষ্টি বলতে উন্নত মাতৃ এবং শিশু স্বাস্থ্য, শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা, নিরাপদ গর্ভাবস্থা এবং প্রসব, অসংক্রামক রোগের (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ) কম ঝুঁকি, এবং দীর্ঘায়ুকে বোঝায় [৩]।


বিজ্ঞাপন


পুষ্টিবিদদের মতে, একজন মহিলার প্রতিদিন ২০০০ ক্যালরি পরিমান খাবার গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে শহরে বসবাসকারী অনেক মহিলা তাদের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারে না আর তখন অপুষ্টি বা পুষ্টি সমস্যা দেখা দেয়।

পুষ্টি সমস্যা বলতে সাধারণত অপুষ্টি এবং অতিরিক্ত পুষ্টি বা অতিপুষ্টি উভয়কেই বোঝায়। অপুষ্টি বলতে সাধারণত শক্তির অভাব, অত্যাবশ্যক ভিটামিন এবং খনিজ ঘাটতিকে বোঝানো হয়। অপুষ্টি মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর অতিপুষ্টি হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের প্রবণতা। বিশ্বে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে অপুষ্টির সমস্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে যার মধ্যে অপুষ্টি এবং অতিপুষ্টি উভয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অপুষ্টির একাধিক রূপ রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ক্ষয় বা স্টান্টিং, অপর্যাপ্ত ভিটামিন বা খনিজ, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা এবং অসংক্রামক রোগ।

হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশন (এইচএসপিএসডি), আইসিডিডিআর,বি গবেষণা করে ফলাফল পেয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, ১৫-৪৯ বছর বয়সী বাংলাদেশি মহিলাদের মধ্যে অপুষ্টির অনুপাত (বিএমআই <১৮) ৩০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ-এ তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে, যখন অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার অনুপাত (বিএমআই ≥২৫) একই সময়ের মধ্যে মহিলাদের ১২ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশ বেড়েছে [৪]। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫-৪৯ বছর বয়সী ১৭ মিলিয়ন মহিলা অপুষ্টিতে ভুগছেন। সেই অনুসারে পাঁচ মিলিয়ন কম ওজনের এবং ১২ মিলিয়ন অতিরিক্ত ওজনের বা মোটা। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রজনন বয়সের প্রায় ৪৬ শতাংশ বিবাহিত মহিলা অতিরিক্ত ওজন বা স্থূল হয়ে পড়বে। প্রজনন বয়সের মহিলাদের মধ্যে বর্ধিত ওজন একটি উদ্বেগজনক সমস্যার কারণ [৫]। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন শিশু জন্ম হয়। বর্তমানে বেশি ওজনের বা স্থূল মহিলা প্রায় ০.৯ মিলিয়ন এবং কম ওজনের মহিলা ০.৫ মিলিয়ন শিশু জন্ম দিয়ে থাকে [৫]।

মায়েদের স্থূলতা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ এবং সিজারিয়ান প্রসবের মতো প্রসবকালীন জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। মায়েদের স্থূলত্ব স্তনপান করানোর ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে, ইচ্ছাশক্তির হার কমে যায় এবং স্তনপান করানোর সময়কাল কমে যায়। এই সমস্ত জটিলতা শিশুর বেঁচে থাকা, বৃদ্ধি এবং বিকাশের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলে [৬]।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশে, শহরাঞ্চলে বসবাসকারী জনসংখ্যার হার সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। জীবিকার তাগিদে ও উন্নত জীবনের আশায় গ্রামের লোকজন শহরমুখী হচ্ছে। শহরে আসা এসব মানুষের অধিকাংশই বস্তিতে বসবাস করে। যার বেশিরভাগই নিন্ম আয়ের লোক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিন্ম আয়ের লোক তাদের চাহিদা অনুযায়ী খাবার কিনতে পারে না, যা তাদের পুষ্টির উপর প্রভাব ফেলে। ২০১৪ একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, নগরে বসবাসকারী মহিলাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বেশ কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা বৃদ্ধির হার দ্রুতগতিতে বেড়ে জাতীয় গড় ২৪ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে শহরে বসবাসকারী লোকজনের চিনি এবং চর্বিযুক্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবারের উপর আগ্রহ বাড়ছে। বিশ্বায়ন ফলে খাদ্য শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছে।

স্বল্পমূল্যে উচ্চশক্তিযুক্ত জুস বা ড্রিংক্স এবং জাঙ্ক ফুড বিক্রি খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে। জাঙ্ক ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবার শহরে অবস্থিত বিভিন্ন সুপার মার্কেট বা বড় দোকানগুলোতে পাওয়া যায়। যার ফলে শহরের লোকজন সহজেই জাঙ্ক ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবারে আসক্ত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শহরবাসীদের অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে শহরের লোকজনের কর্মব্যস্ততার ফলে সময়ের অভাবে স্বাস্থ্যকর এবং ঘরে তৈরি খাবার তৈরির আগ্রহ কমে যাচ্ছে। যার ফলে সহজলভ্য ফাস্ট ফুড খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। আবার শহরে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা না থাকাতে নগরবাসীর মধ্যে শারিরীক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের প্রবণতা কমে যাচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক পরিশ্রম কম হওয়ায় খাবার প্রতি অনীহা বাড়ে ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। এসব কারণে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে [৬]।

দেশে অপুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার বিভিন্ন নীতি অনুসরণ করে থাকেন। বর্তমানে পুষ্টি সম্পর্কিত তিনটি প্রধান সরকারি নীতি আছে। সেগুলো হলো, মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় কৌশল ২০১৯-২০৩০, জাতীয় পুষ্টি নীতি ২০১৫ এবং পুষ্টির জন্য দ্বিতীয় জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা ২০১৬-২০২৫। মাতৃস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বর্তমান নীতিগুলি পুষ্টি সর্ম্পকিত এবং বেশিরভাগই কম বা বেশি ওজনের সমস্যার সমাধান করে [২]। এর পাশাপাশি সরকারি সেক্টরে পুষ্টি সম্পর্কিত কাজের সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞরা যদি বেসরকারি সেক্টরে জড়িত হয়েও পুষ্টি সমস্যা ও পুষ্টি উন্নয়নের জন্য কাজ করেন তাহলে গোটা দেশ এর সুফল ভোগ করবে।

এনজিওর প্রোগ্রাম, গবেষণা এবং প্রচারে পুষ্টির উদ্দেশ্যগুলি সফল করার জন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার। পুষ্টি সম্পর্কিত সচেতনতার বৃদ্ধিতে নিয়মিত কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুষ্টি জ্ঞান, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ এবং শারিরীক কার্যক্রম সম্পর্কে জানানো উচিত। রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেটে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পুষ্টি জ্ঞান, সচেতনতা, কম ওজন বা বেশি ওজন সমস্যা নিয়ে আলেচনা করা ও অসক্রামক রোগ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

লেখক: ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা)
এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলাপমেন্ট, কনসালটেন্ট, ইউনিসেফ

আতিয়া রহমান (গবেষণা সহকারী), এমিন্সেস এস্যোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট

রেফারেন্স
1.    bbs.portal.gov.bd
2.    ideas.repec.org
3.    who.int
4.    bangladeshpost.net
5.    sciencepublishinggroup.com
6.    axiawh.com

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর