শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সব কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে

রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২৩, ০৫:৩৭ পিএম

শেয়ার করুন:

সব কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে

নবগঙ্গা নদীর পাড়ে একটি সিঁড়ি বাঁধানো ঘাট করার উদ্যোগ নেওয়া হয় বহু বছর আগে। সিঁড়িটি সম্পন্ন না হতেই তা প্রায় ধ্বংস হওয়ার পথে। ঘটনাটি আমার নজরে আনেন এলাকার একজন সমাজসেবী। অনেকটা সময় চিন্তাভাবনা করে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধার সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি বেশ আগ্রহ প্রকাশ করলেন এই ভেবে যে সেখানে আমাদের অনেকের স্মৃতি জড়িত। ছোটবেলায় সেখানে সাঁতার কেটেছি। সেই খেয়াঘাট দিয়ে জীবনের ছোট বড় অনেক জার্নি করেছি। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো হৃদয়ে বেশ দাগ ফেলেছে। তারপর সেই খেয়াঘাটের পাড়ে ছিল এক বিশাল ফুলগাছ, যেখানে কতই না সময় কেটেছে আমার। সরকারি জায়গা হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না ভেবে শেষে মাগুরা জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল তৎকালীন ডিসিকে একটি চিঠি লিখি। ডিসি সাহেব বেশ আগ্রহের সাথে বাকি কাজটি সম্পন্ন করবেন বলে কথা দিলেন। দিনকাল এবং একটি সময় ঠিক করে কাজটিতে হাত দেবেন- এমন সময় ডিসি সাহেবের বদলি হয়ে যায়। নতুন করে পুরনো কাহিনী তুলে ধরি সদ্য আগত ডিসি সাহেবকে। তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন, ঘটনাটি শুনলেন এবং এও বললেন আমি যেন স্থানীয় কাউকে দায়িত্ব অর্পণ করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। আমি আমার এলাকার সেই সমাজসেবীকে ডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলি। সমাজসেবীর সঙ্গে দেখা ও কথা হয় মাগুরার ডিসির। তারপর কয়েক মাস হয়ে গেল কিন্তু সিঁড়ি মেরামত কাজের কিছু হয়নি। শীতের সময়ই কাজটি শেষ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, কারণ বর্ষা শুরু হলে নদী পানিতে ভরে যাবে। তখন কাজটি স্বল্পখরচে করা সম্ভব হবে না। কি করি? নানাভাবে চেষ্টা করে কোনো উপায় না পেয়ে এলাকার দায়িত্বশীল সংসদ সদস্যকে ফোন করি এবং তাকে বিষয়টি অবগত করি। একই সাথে ডিসি সাহেবকে লেখা আমার চিঠি এবং ঘাটের সিঁড়িসহ কিছু অসমাপ্ত কাজের ছবি এমপি মহোদয়কে পাঠাই।

এখন অপেক্ষার পালা। দেখি এই সামান্য কাজটি কখন কিভাবে সম্পন্ন হয় বা হয়তো সম্পন্ন নাও হতে পারে। সম্পন্ন হোক আর না হোক সেটা পরে নিশ্চিত করে লিখব। তবে যে কারণে আমি ঘটনাটি তুলে ধরছি সেটা হলো বিশ্বের পরিকাঠামো এবং তার ম্যানেজমেন্ট কোথায় কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তার ওপর আলোকপাত করা। আমি দুটো জায়গার ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরব। একটি শিল্পকারখানা, অন্যটি গণতন্ত্রের দেশ সুইডেন। এই দুটি জায়গার কাজের ধরন কি রকম এবং বিষয়টি কিভাবে শিক্ষণীয় হতে পারে পরবর্তীতে সেটা নিয়ে আমার লেখাটি শেষ করব।


বিজ্ঞাপন


আমি যে শিল্প-কারখানার মধ্যদিয়ে বড় হয়েছি সেটা হলো ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি। আমি সেখানে কাজ করেছি। মূলত আমরা যে যেখানে বা যে ধরনের কাজ করি না কেন সমস্যার ধরনগুলো এক রকমই। কারণ একটি সমস্যার পেছনে নানা ধরনের জটিলতা জড়িত থাকে। যেমন- দায়িত্ব, অর্থ, মধ্যস্থতা, জনশক্তি, সময় এবং সর্বোপরি ফলোআপ। সমস্যা ছাড়া একটি ইন্ডাস্ট্রি, একটি দেশ, একটি প্রতিষ্ঠান বা একটি পরিবার হতে পারে না এবং ভালো ম্যানেজমেন্ট ছাড়া সেগুলো সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে পারে না। সেক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্টের কাজই হচ্ছে কি, কখন, কে, কেন, কিভাবে ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত থাকা এবং তার শতভাগ দায়বদ্ধতার সাথে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। ম্যানেজমেন্টে যদি এর একটা বাদ পড়ে যায় তখনই চ্যুতি বা ডেভিয়েশন দেখা দেয়। ইন্ডাস্ট্রিতে এসব কাজ খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা না থাকার কারণে ব্যর্থ হয় ম্যানেজমেন্ট তার কর্মের প্রতিফলন ঘটাতে। একটি দেশ বা একটি ইন্ডাস্ট্রি যখন সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তখন ধরে নিতে হবে ব্যর্থ চালক এবং তাকে সরাতে বা সারতে হবে আগে। আমার ওপরের অসম্পূর্ণ সিঁড়ি ঘাট কেন এত বছরেও সম্পন্ন হয়নি? এই প্রশ্নের জবাব নেই, নেই দায়বদ্ধতা, নেই জবাবদিহিতা। অথচ রাষ্ট্র ঠিকই বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বেতনসহ সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চলেছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। আজ যদি সঠিক ফলোআপ হতো, আজ যদি ম্যানেজমেন্ট তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতো তাহলে সিঁড়িঘাটটি অনেক আগে থেকেই ব্যবহারের যোগ্য হতে পারত। কিন্তু সে সিঁড়ি দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতি আর অনীতির সাক্ষী হয়ে। কোথাও কেউ নেই যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বা কিছু করার জন্য চেষ্টা করছে। সুইডেনে এমন একটি ঘটনা সারা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করত, জবাবদিহি থেকে শুরু করে সবকিছু তদন্ত করা হতো। শেষে কাজটি সম্পন্ন তো হতোই, সাথে হতো শিক্ষণীয়। যেখানে সত্যিকার গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাক্টিসের অভাব এবং দুর্নীতিতে ভরপুর সেখানেই এ ধরনের ডেভিয়েশন লক্ষণীয়। সুইডেনের রাজনীতিতে এ ধরনের গাফিলতি হয়, তবে সঠিক জবাব না দিতে বা দেখাতে পারলে ব্যক্তির চাকরি থাকে না। ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে আরো কড়া নজরদারি মেনে চলা হয়।

dm

বাংলাদেশ এর বাইরে তা নয়। পার্থক্য শুধু একটা- সেটা হলো দুর্নীতি এখানে বড় আকারে কাজ করে। ফলে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়। তাছাড়া দেশভরা নেতা আছে কিন্তু নেতার অনুসারী নেই। নেতা তার মনুষ্যত্ব, লজ্জা শরম এবং বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। নেতা বলছেন কি করতে হবে কিন্তু কে কার কথা শোনে। জনগণ বুঝে গেছে নেতার নেতৃত্বের সুযোগ করে দিলে সে করবে পরিবর্তন নিজের এবং পরিবারের। সেক্ষেত্রে জনগণের কি হবে? হয়ত সবাই বলবে, তাহলে মিটিংয়ে নেতার বক্তৃতা শুনতে এত লোক জড়ো হয় কেন? মওলানা মিজানুর রহমানের ওয়াজ শুনতেও জনগণ যায়, তার অর্থ এই নয় যে তিনি যা বলছেন জনগণ সেভাবে কাজ করছে। জনগণ স্ট্রিট স্মার্ট, তাই তারা চোখ কান খোলা রেখে সব শুনছে, দেখছে এবং তারপর তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে। লন্ডন বা ঢাকার লাক্সারি পরিবেশে বসে যেসব নেতা অর্ডার করছে কি করতে হবে তাদের কথা কেউ আর শুনছে না। সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারীরা তাদের রুটিন অনুযায়ী কাজে হাজিরা দিচ্ছে মাত্র। দেশের রাজনীতিতে শুধু ধান্দাবাজি, যার কারণে নেতার পেছনে কোনো অনুসারী নেই, আছে শুধু চামচারা।

জনগণ তো এখন আগের মতো বোকা না যে যখন যার যা খুশি বলবে আর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে দিন গুজার গিয়া। দেশের প্রতি যদি সত্যিই এত দরদ তাহলে আগের সেই শহিদ ভাইদের মতো করে কেন আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিনা? কারণ আমরা জনগণ বারবার শুধু জর্জরিত, শোষিত, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত। আমাদের ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। হতাশায় নিমজ্জিত আমাদের সমস্ত শরীর। মন বলে শোষণ, শাসন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সোচ্চার হই আর ঝাঁপিয়ে পড়ি কিন্তু না তা করব না, কারণ আমরা শান্তিপ্রিয় শান্ত জনগণ। আমরা এখন ভীতু হয়ে গেছি, প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি, আর অপমান সইতে শিখেছি। নীতিহীন এবং পথভ্রষ্ট নেতার নেতৃত্বের কারণে আমরা এখন নিজের দেশে পরাধীন।


বিজ্ঞাপন


আমাদের ম্যানেজমেন্টের প্রশিক্ষণের ধরনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন। বন্ধ করুন মুখস্তধারী তোতাপাখি নিয়োগ প্রক্রিয়া, চালু করুন রাইট ফার্স্ট টাইম, রাইট ফ্রম মি, অন দ্য জব ট্রেনিং কনসেপ্ট। বিসিএস পাশ করে দেশের দায়ভার নিলে দেশকে সোনার বাংলা করা যে সম্ভব না তার প্রমাণ ৫২ বছরই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের সব বিসিএসধারী যন্ত্রের অতিসত্বর অবসান ঘটিয়ে তাদেরকে চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, একই সাথে জনগণের প্রতিনিধিদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। টিকিট কেনার অর্থ থাকলেই কিন্তু দেশ ভ্রমণ করা যায় না, দরকার হয় ভিসার। বাংলাদেশকে সঠিক পথে চালিত করতে শুধু টিকিট কেনার অর্থ থাকলেই হবে না বা টিকিট দিলেই হবে না, দেখতে হবে তাদের দেশ চালানোর যোগ্যতা আছে কিনা। কেস স্টাডি করুন। ওপরের অসমাপ্ত সিঁড়িঘাটই যথেষ্ট একটি কেস স্টাডির জন্য। একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ‘রাইট পারসন রাইট প্লেস কনসেপ্ট’ ব্যবহার করুন, অর্থ বিনিয়োগ ছাড়া। দেখবেন দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

সঠিক শিক্ষা শেষে যখন সিভিল প্রশাসন কাজে যোগদান করবে তখন তারা সুষ্ঠুভাবে এ ধরনের কাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে, একই সাথে ফলোআপ করা শিখবে। সামান্য একটি ঘাটের সিঁড়ি এত বছরেও সম্পন্ন হয়নি কিন্তু কে এর জন্য দায়ী এবং কার জবাবদিহি বাদ পড়েছে? কে টাকা মেরেছে- ইত্যাদি বিষয়গুলো যদি মনিটর না করা হয় তবে এমন সমস্যা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু যদি দেশ সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তাহলে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা চিরজীবনের জন্য বিদায় নেবে দেশ থেকে। একই সাথে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সতর্ক হবে এবং তারা জানবে কত ধানে কত চাল। দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৫২ বছর চলছে এখন, সঠিক ম্যানেজমেন্ট তথা দেশের অবকাঠামো গঠন করা হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কবে সম্ভব হবে এই ছোট্ট কাজটি সঠিকভাবে পরিচালনা করা?

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
[email protected]

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর