শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে’র পতনের কারণ

বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ
প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০২৩, ০৬:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে’র পতনের কারণ

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ কারিগরি সম্পর্কিত স্টার্টআপস ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলোর সাথে সম্পর্কের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ (এসভিবি)। এসভিবি মাত্র দুই দিনের মধ্যে ভেঙ্গে পড়বে তা কোনো আর্থিক বিশ্লেষক বা অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞও বুঝতে পারেননি। এসভিবি গত ১০ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংক ছিল। এসভিবি ১৯৮৩ সালের ১৭ অক্টোবর অর্থাৎ ৩৯ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকের শাখা কানাডা, চীন, জার্মানি, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রদেশেই রয়েছে। এই ব্যাংক পতন হওয়ায় গত ১৩ মার্চ এই ব্যাংকের বীমাকৃত এবং অবীমাকৃত ডিপোজিটসহ সব সম্পদ ‘সিলিকন ভ্যালি ব্রিজ ব্যাংক, এনএ’ এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এক দশক আগে আর্থিক সঙ্কটের সময় ‘ওয়াশিংটন মিউচুয়াল’ পতনের পর গত ১৩ মার্চ ‘এসভিবি’র পতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

এসভিবি’র বিজনেস


বিজ্ঞাপন


সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের বিজনেস স্লোগান ছিল- ‘ন্যায়সঙ্গত এবং কম কার্বন নির্গমন অর্থনীতি তৈরিতে অবদান রাখা’। বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক টেক কোম্পানিগুলোর আর্থিক চাহিদা পূরণ, নতুন নতুন স্টার্টআপে ঋণ দেওয়া এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল যোগান দেওয়া ছিল এই ব্যাংকের প্রধান কাজ। এসভিবিকে বলা হয় ‘বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি গ্রহণকারী ব্যাংক’। কোভিড মহামারির সময় প্রযুক্তিকেন্দ্রিক কোম্পানিগুলোর পছন্দের ব্যাংক হিসেবে এই ব্যাংকের পরিষেবাগুলোর চাহিদা ছিল তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার স্টার্টআপস আছে যারা করোনা পরবর্তীতে মার্কিন সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে অনেক ঋণ পায় এবং সেই ঋণের টাকা এই ব্যাংকে ‘Non-interest bearing demand account’ (বাংলাদেশের ব্যাংকের চলতি হিসাবের মতো) এ জমা রাখে। ফলে গত তিন বছরের মধ্যে আমানতের পরিমাণ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪২ বিলিয়ন থেকে ১২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে। করোনা মহামারির সময় এবং করোনা পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক কোম্পানিগুলোর উপর মার্কিন সরকারের আর্থিক প্রণোদনার প্রত্যক্ষ পজিটিভ প্রভাব থাকায় বিশাল অংকের ডিপোজিট বৃদ্ধি পায়। ‘এসভিবি’ তুলনামূলক বেশি মুনাফা এবং নিরাপদ বিনিয়োগের কথা মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে। ২০১৯ সালে বিনিয়োগ ছিল ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিনিয়োগের ৯৭ শতাংশই ছিল ১০ বছর ও তদূর্ধ মেয়াদী এবং এই বিনিয়োগগুলো ছিল Mortgage based Securities (MBS)। এছাড়া এই বিনিয়োগের উপর গড় সুদ হার ছিল ১.৫৬%।

ধারাবাহিক ঘটনা এবং বাজার আচরণ

যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ বছরের ইতিহাসের মধ্যে ২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত চলমান মুদ্রাষ্ফীতি হলো সবচেয়ে বেশি। গত দুই বছর ধরে প্রযুক্তি ব্যবসার মন্দাবস্থা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্ট মুদ্রাষ্ফীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য মার্কিন ফেডারেল রির্জাভ সুদের হার বৃদ্ধি করার আক্রমণাত্মক পরিকল্পনার গ্রহণ করে।

মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃক সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বাজারে বন্ডের মূল্য দ্রুত পড়ে যায়। সুদের হারের সাথে বন্ডের বাজার মূল্যের সম্পর্ক iverse মানে বিপরীত। অর্থাৎ সুদের হার বাড়লে বন্ডের দাম কমে এবং vice versa। যার ফলে ‘এসভিবি’র আনরিয়ালাইজড লোকসান হয় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ‘এসভিবি’ কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের এপ্রিলে এই ব্যাংকের ‘প্রধান রিস্ক অফিসার’কে অপসারণ করলেও চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ওই পদে কাউকে স্থলাভিষক্ত করা হয়নি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলমান থাকা এবং মূল্যষ্ফীতির কারণে ২০২২ থেকে টেক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা মন্দা ছিল। একই সময়ে Startups কোম্পানিগুলো তাদের কর্মচারীর বেতন এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য নগদ অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে অন্য গ্রাহকের সাথে সাথে এই কোম্পানিগুলো ব্যাংক থেকে গত ৯ মার্চ ৪২ বিলিয়ন ডলার উত্তোলন করে। আমানত উত্তোলনকারীদের মধ্যে ‘এসভিবি’র প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তারাও ছিল। এক দিনে ৪২ বিলিয়ন ডলার আমানত উত্তোলনের ফলে ওইদিন ব্যাংকটির নেগেটিভ ক্যাশ ব্যালেন্স দাঁড়ায় প্রায় ১বিলিয়ন মার্কিন ডলার।


বিজ্ঞাপন


Impact বা প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক পতনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং বা আর্থিক সিস্টেমে Systematic Risk (যে ঝুঁকি এড়ানো যায় না) সৃষ্টি হতে পারে। যাই হোক না কেন, বিশেষজ্ঞদের এই উদ্বেগ ক্ষণস্থায়ী হলেও কিছু টেক কোম্পানি, startups উদ্যোক্তা কিংবা কিছু ব্যাংক যাদের নগদ প্রবাহ (Cash Flow) কম তারা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই ক্ষেত্রে মার্কিন সরকার দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে Domino Effect হতে পারে। অর্থাৎ একটি ব্যাংকের পতন অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর একটি কঠোর ডমিনো প্রভাব (একটি ঘটনা ধারাবাহিকভাবে সম্পর্কিত ঘটনাকে অনুসরণ করে) ফেলতে পারে।

কাস্টমার

Startups উদ্যোক্তারা ফান্ড উদ্ধার করতে পারে না, ফলে ব্যবসার পরিচালন ব্যয় নির্বাহ কঠিন পড়ে। Venture Capital মার্কেট সংকুচিত হয়ে পড়ে। যার ফলে এতদসংক্রান্ত কোম্পানিগুলো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে তাদের জমানো আমানত তুলতে পারছে না। যার ফলে ‘এসভিবি’র উপর গ্রাহকরা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

ক্যাপিটাল মার্কেট

গ্রাহকদের নগদ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ‘এসভিবি’র কাছে রক্ষিত বিক্রয়যোগ্য সিকিরিটি ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করে। ফলে ১.৮ বিলিয়ন ডলার লোকসান হয়। এছাড়া, এসভিবি নতুন করে বাজার থেকে ক্যাপিটাল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। আরও উল্লেখ্য, ওই ব্যাংকের আনরিয়ালাইজড লোকসান ১৫ বিলিয়ন ডলার হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মোডি (Moody) ব্যাংকটি পতন হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে ‘Potential Downgrade’ হিবেবে Credit Rating করেছিল। এই খবরগুলো Snow ball effect (তুষার বল প্রভাব- প্রথমে বলটি ছোট থাকে এবং গড়াতে গড়াতে নিচে যায় ও বলে তুষার লেগে লেগে বড় ও তরান্বিত হয়) এর মতো মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটাল মার্কেট হলো ‘কার্যকরী ক্যাপিটাল মার্কেট (Efficient Capital Market)’। যেকোনো তথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার তাৎপর্য অনুযায়ী তৎক্ষণাৎ সাড়া দেয়। গত ৯ মার্চ ‘এসভিবি’র শেয়ার মূল্য ৬০ শতাংশ পড়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৩ মার্চ ‘এসভিবি’র পতন ঘটে।

এসভিবি গত ১০ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংক ছিল।

‘এসভিবি’ পতন হওয়ায় দুই দিনে ইউএস মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমেছে। কিছু কিছু আমানতকারী তাদের ডিপোজিট হস্তান্তরের নিরাপত্তা চেয়ে বড় বড় কমার্শিয়াল ব্যাংককে পত্র দিয়েছে। অন্যদিকে কিছু বড় বড় ব্যাংক যেমন- First Republic Bank এবং Western Alliance Bancorporation কাস্টমারদের ‘পেনিক না হয়ে শান্ত থাকার বিষয়ে’ সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছে। ‘এসভিবি’র পতন হলেও আমেরিকার ব্যাংকিং বিশেজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালের সংগঠিত আর্থিক সঙ্কটের পর থেকে আর্থিক ব্যবস্থার নিয়ম কানুন আরও শক্তিশালী ও সময়োপযোগী করেছে বিধায় আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের অঘটন ঘটবে না। কিন্তু কোভিডের পর এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাষ্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংক (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক) সুদের হার বৃদ্ধি করে ফলে বাজারে বন্ডের দাম দ্রুত হ্রাস পায়।

কেন ব্যর্থ হলো?

১। মুদ্রাষ্ফীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য মার্কিন ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি করার আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা।
২। ব্যাংকটি গত কয়েক বছরে সাধারণ গ্রাহকদের আমানত দীর্ঘমেয়াদি (১০ বছর মেয়াদি) সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ।
৩। ব্যাংকের আমানতের মেয়াদ এবং বিনিয়োগ মেয়াদের মধ্যে মারাত্মক অসামঞ্জস্য থাকা।
৪। দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ হওয়ার কারণে বন্ডের বাজার যোগ্যতা বা Marketability না থাকায় জরুরি অবস্থায় বন্ডগুলো বিক্রি করাও সম্ভব হয়নি।
৫। মার্কিন সরকার কর্তৃক বেইল আউট ঘোষণা না করা।
৬। বাজার থেকে নতুন করে ক্যাপিটাল সংগ্রহ করেতে না পারা।
৭। ‘এসভিবি’ কর্তৃপক্ষ এপ্রিল ২০২২-এ ব্যাংকের ‘প্রধান রিস্ক অফিসার’কে অপসারণ করলেও জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত ওই পদে কাউকে স্থলাভিষক্ত না করা।
৮। ব্যাংকটি ব্যর্থ হওয়ার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল আমানত বীমার উপর মার্কিন সরকারের আরোপিত সীমা ২,৫০,০০০ ইউএস ডলার। এই ব্যাংকের গ্রাহক সাধারণত ব্যবসায়ী এবং ধনী ছিলেন তাদের আমানতের পরিমাণ ২,৫০,০০০ মার্কিন ডলারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ফলে গ্রাহকদের আমানত হারানোর আতঙ্কও এই ব্যাংকের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
৯। ব্যাংক গ্রহকদের নগদ অর্থের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে লোকসানে সম্পদ বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করছে। এই আতঙ্কের কারণে সব গ্রাহক তাদের আমানত তুলে নিতে কিংবা অন্য বড় ব্যাংকে হস্তান্তরের জন্য একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
১০। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এত বিশাল আমানত উপর্যুক্ত প্রকল্পে বিনিয়োগ করার সামর্থ না থাকা।

অবশেষে ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা গত ১৩ মার্চ সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের অবশিষ্ট সম্পদ এবং আমানতকারীদের অবশিষ্ট আমানত রক্ষা করার জন্য ব্যাংকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে। এক্ষেত্রে একটি মজার বিষয়- Forbes ‘এসভিবি’কে ‘আমেরিকার বেস্ট ব্যাংক ২০২৩’ ঘোষণা করেছিল কিছুদিন আগে, যা ‘এসভিবি’র টুইটার একাউন্টে ৬ মার্চ পোস্ট করা হয়। তবে ব্যাংকটির পতনের ৩ দিন আগে পোস্টটি টুইটার একাউন্ট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

লেখক: ম্যানেজার এবং এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার
কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চ 
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর