এক.
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার নজির। ২০১৭ সাল থেকে এ দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে।
একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে ঢাকায় চালানো ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
বিজ্ঞাপন
দুই.
২৫ মার্চ। সন্ধ্যা থেকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। সেই দুঃসময়ের রাতে তাঁদের স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে : আগুন জ্বলছে পলাশীর বস্তিতে, বিদ্রোহ ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে, দাউদাউ করে জ্বলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। রাতের শেষ প্রহরে কামানের গর্জন। আগুনের ফুলকি চতুর্দিকে। সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার নির্দেশে, জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের সামরিক অভিযানে সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা।
জাতিসংঘের ঘোষণায় ‘জেনোসাইড’-এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন হয়েছে সেদিন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, জহুরুল হক হলসহ সারা ঢাকা শহরে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হয় বিদেশি সাংবাদিকদের; যাতে করে কেউ গণহত্যার কোনো সংবাদ পরিবেশন করতে না পারেন।
গণহত্যার এই রাতে সেনাবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, ‘পিপলস’, ‘গণবাংলা’ ও ‘সংবাদ’-এর কার্যালয়ে।
তিন.
অপারেশন সার্চলাইট। ২৫ মার্চ ১৯৭১। পৃথিবীর বুকে নৃশংসতম এক গণহত্যার নাম। বাঙালি যখন তার অধিকারকে আঁকড়ে ধরেছিল, বর্বর পাকিস্তানিরা তখনই বুঝতে পেরেছিল কোনো কিছু দিয়েই এই জাতিকে দাবায়ে রাখা যাবে না। তাই একাত্তরের সেই রাতে শুরু করে জঘন্যতম গণহত্যা। যা জন্ম দেয় মুক্তিযুদ্ধের। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম।
আর্চার ব্লাডের লেখা ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগানের গুলি চালিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল।
২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অগণিত ছাত্র-ছাত্রী নিহত হয়েছিলেন। ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের মাঠে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে, আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিস, প্রেসক্লাবে আগুন ধরিয়ে, কামান ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় শাঁখারীপট্টি ও তাঁতিবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে।
ঢাকার অলিগলিতে, বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে লাখ লাখ নর-নারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
বিজ্ঞাপন
চার.
আক্রমণের প্রথম হিটলিস্টে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এরা কারফিউ জারি হওয়ার সাথে সাথে ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট লঞ্চার, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে এবং হলগুলোতে গণহত্যা শুরু করে। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল এবং সলিমল্লাহ মুসলিম হল ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু।
অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব ও শাহ চিশতী হেলালুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে কেন্দ্র করে। তাই অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। হলটি নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। ৭ জন শিক্ষকসহ প্রায় ২০০ জন ছাত্র-কর্মচারীকে পাকবাহিনী হত্যা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলিগ নেতা শাহ চিশতী হেলালুর রহমানকে হলের ২১৫ নম্বর রুমে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
এরপরে হানাদার বাহিনী জগন্নাথ হলে মর্টার আক্রমণ চালায়। সেই সাথে চলতে থাকে অনবরত গুলিবর্ষণ। জগন্নাথ হলের উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকে নির্বিচারে প্রায় ৪১ জন ছাত্র ও ২১ জন কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। হানাদার বাহিনী শহিদুল্লাহ হল এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে প্রবেশ করে অগণিত ছাত্র ও কর্মচারীদের হত্যা করে। রোকেয়া হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও বিহারিরা আক্রমণ করে হল কোয়ার্টারের ৪৫ জনকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। অপারেশন সার্চলাইটে সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
এরপর পাকিস্তানি সেনারা রাজারবাগ পুলিশলাইনে আক্রমণ করে অগণিত পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। সেখান থেকেই পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ শুরু হয়। কিন্তু রাজারবাগ পুলিশলাইনের পুলিশেরা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি পাকিস্তানিদের আধুনিক অস্ত্রের অনবরত আক্রমণের মুখে।
পুরো ঢাকা শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাণ্ডবলীলা চালায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পুরো ঢাকাকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করে। তারা ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা উড়িয়ে দেয়। এতে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি শহীদ হয়। ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের তৎকালীন সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মতে,
২৫ মার্চ রাতে (তৎকালীন) ইকবাল হলের ২০০ ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় শিক্ষক ও তাদের পরিবারের ১২ জন নিহত হওয়ার সংবাদ পরিবেশিত হয়। পুরোনো ঢাকায় পুড়িয়ে মারা হয় ৭০০ লোককে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে ঐ রাতে শুধু ঢাকায় ৭ হাজার বাঙালি নিহত হয়।

পাঁচ.
২৫ মার্চ ঠিক যেমনটি ঘটেছিল বাংলাদেশের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ'-এর নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতার জীবনে। সেই রাতের কথা মনে হলে, সবকিছু ছাপিয়ে আজও মেঘনার মনে পড়ে হানাদার বাহিনীর পায়ের শব্দ, গোলা-গুলির ভীতিকর আওয়াজ।
তিনি তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। অধ্যাপক বাবা ও স্কুল শিক্ষক মাকে ঘিরে সুখী এক পরিবার। অথচ একাত্তরের মার্চ মাসের সেই কালো রাত তাঁদের জীবনটাকে একেবারে উল্টে-পাল্টে দিলো।
মেঘনা বললেন, ‘আমার বাবা ছিলেন ইংরেজি ভাষার শিক্ষক। তিনি খাতা দেখছিলেন সেই রাতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর মা বাড়িতেই অন্য একটা ঘরে ছিলেন। হঠাৎ করে প্রচণ্ড- গোলা-গুলির শব্দ শোনা গেলে, আমায় জাগিয়ে তোলা হয়। এরপরই পাকিস্তানি সেনারা এসে হানা দেয় আমাদের বাড়িতে। ধাক্কা দিয়ে, লাথি দিয়ে দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার উপক্রম করে। বাগান দিয়ে ঢোকে তিনজন সৈনিক এবং এসে তারা বাবাকে নিয়ে যায়।
সে সময় যেহেতু শিক্ষকরা একটা অহযোগ আন্দোলন করছিলেন, তাই আমরা ভেবেছিলাম যে তারা বাবাকে ‘অ্যারেস্ট’ করতে এসেছে। কিন্তু পর মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারলাম। না, অ্যারেস্ট নয়...তারা বাবাকে প্রথমে তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করে। বাবা তাঁর নাম বলেন। তারপর তাঁর ধর্ম কী-তা জিজ্ঞাসা করে। বাবা বলেন হিন্দু। এরপরই বাবাকে প্রথমে ওরা ঘাড়ে গুলি করে। তারপর দ্বিতীয় গুলিটা করে কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা পড়ে যান।’
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভেতরে ভেতরে যেন আরও একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মেঘনা গুহঠাকুরতার পরিবারে। গুলিবিদ্ধ হয়েও বাবা জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কোয়ার্টারে ও ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়লেন কয়েক দিন। মারা গেলেন একরকম বিনা চিকিৎসায়। সেদিনের সে কথা মনে করে আজ মেঘনার ভাষ্য, ‘২৫ মার্চের রাত্রি, ২৬ মার্চের দিন এবং রাতÑএই পুরো ২৪ ঘণ্টা আমরা বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। কারণ, সে সময় কার্ফিউ চলছিল। টহলদার বাহিনী সবাই গুলি করছিল। পরে ২৭ তারিখের সকালে কার্ফিউ ভাঙার পর, আমরা রাস্তার কিছু সাধারণ মানুষকে ডেকে বলি বাবাকে উল্টো দিকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তখনও বাবা সচেতন এবং জীবিত। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা জানান যে, ‘ক্রিটিকাল ইঞ্জুরি’-র কারণে আর কিছুই করা সম্ভব নয়।’
অর্থাৎ একটা ১৫-১৬ বছরের মেয়েকে ২৪ ঘণ্টারও বেশি একটা সময় আহত বাবার হাত ধরে বসে থাকতে হয়েছিল। একটা দেশে একদিকে যখন ভবিষ্যতের ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে ছোট্ট একটা মেয়ের জীবনে চিরদিনের জন্য দাগ কেটে যাচ্ছে সেই ইতিহাসের চরম বাস্তবতা।
মেঘনা জানান, ‘আমি তখন কান্নাকাটি করছি। মাকে বলছি, মা তুমি দেওয়াল টপকিয়ে নার্সদের হোস্টেলে যাও। একজন নার্সকে নিয়ে এসো। বা স্বপ্ন দেখছি, ইস্ যদি একটা রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যেতÑতাহলে বাবাকে তাদের হাতেই তুলে দিতাম। বাবা সুচিকিৎসা পান, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তখন সেটাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র বাবাই টের পেয়েছে যে ইতিহাস রচিত হচ্ছে। কারণ আহত অবস্থাতেই বাবা আমার মাকে ধরে বলেছিলেন, লেখো। মা বলছেন, কী লিখবো? বাবা বললেন, ইতিহাস। মা তখন বলেছিলেন, আমি যে ইতিহাস লিখতে পারি না। শুনে বাবা বলেছিলেন, তাহলে সাহিত্য লেখো। সেই কথার সূত্রেই ওই ঘটনার প্রায় ২৫ বছর পর, মা একটি বই লিখেছিলেন ‘একাত্তরের স্মৃতি’।
ছয়.
২৫ মার্চের গণহত্যা ছিল জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তী ৯ মাসে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল সেই বর্বর ইতিহাস, নিষ্ঠুরতা এবং সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদি নিধনযজ্ঞ (হলোকাস্ট) বা রুয়ান্ডার গণহত্যাকেও অতিক্রম করে গেছে।
আমেরিকার সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যার অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে সিলেক্টিভ জেনোসাইড বা জেনোসাইড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ড্যান কগিন টাইম ম্যাগাজিন-এ এক লেখায় এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উদ্ধৃতি প্রচার করেন : ‘আমরা যে কাউকে এবং যেকোনো কিছুকে হত্যা করতে পারি। কারও কাছে আমাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না।’
২৫ মার্চ রাতে কি নৃশংসতম হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে তার পরেরদিনের লাশের মিছিল দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায়। তবে সেই ভয়াল রাতে কত বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে—এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার ভাষ্য, কেবল ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় একলাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়—১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক মহলের মতেও ১৯৭১ সালে ‘তিন মিলিয়ন’ বা ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংখ্যার সমর্থন আছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন, এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা ও কমটন্স এনসাইক্লোপিডিয়ায়। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজের ডায়েরিতে লেখেন, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দেবেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় ১৩ জুন ১৯৭১ প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট প্রকাশ করেন। পৃথিবীর মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ৯ মাসে এত মানুষ হত্যা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়াই ছিল মুশকিল। একমাত্র খুলনার চুকনগরেই ২০ মে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
সাত.
২৫ মার্চ টিক্কা খান তার পরিকল্পনা সফল করতে পুরো ঢাকা শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে, হাজার হাজার মানুষের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম বাধাগ্রস্থ করতে চেয়েছিল। বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা থেকে বাংলার কসাই হয়ে আরেকটি বিদ্রোহ দমনের তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিল হয়তো, তার সাথে ইয়াহিয়াও। কিন্তু টিক্কা খানেরা জানতো না, বাঙালি দমে যাওয়ার পাত্র না। ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’- এ চেতনা হাজার বছর ধরে বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত।
এএস

