বারবার কেন ঘটছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। ২০০৫ সালের জঙ্গি হামলার বিষয়টি চলে আসে যেকোনো বিস্ফোরণ হলেই। কথায় বলে ‘চুন খেয়ে যার মুখ পোড়ে দইয়েও তার ভয় জাগে’। ঘরে-বাইরে ‘বোমা’র সঙ্গে বসবাস করছে মানুষ। শয়নকক্ষে লাগানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটিও পরিণত হচ্ছে দানবে। গাড়িতে বসানো সিএনজি সিলিন্ডার যেন চলন্ত বোমা। কারখানার বয়লার কিংবা রাসায়নিকের গুদাম একেকটি মরণাস্ত্র। বারবার এগুলোর ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যাচ্ছে। বিস্ফোরণে ঝরছে তাজা প্রাণ। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক। কিন্তু কেন এই বিস্ফোরণ? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে কি? গত এক বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহস্রাধিক মানুষ হতাহত হয়েছেন। বিশেষ করে গত কয়েক দিনের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রামে এমন ভয়াবহ তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা দেশবাসীকে শঙ্কায় ফেলেছে। উঠেছে নানা প্রশ্ন।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন প্লান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের কয়েকদিনের মাথায় এবার বিকট শব্দে কেঁপে উঠল রাজধানীর সিদ্দিকবাজার। এত বড় বিস্ফোরণ ঢাকা শহরে আর কখনও ঘটেনি। মঙ্গলবার বিকালে একটি সাত তলা ভবনের বেজমেন্ট থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে নিচের দুটি ফ্লোরের ছাদের একাংশ ধসে পড়ে। সাইনবোর্ডসহ ভবনটির বিভিন্ন অংশ উড়ে গিয়ে সড়কের অপর পাশের স্থাপনায় মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। নিভে যায় শবেবরাত উপলক্ষ্যে রোজা রেখে ইফতারি কিনতে যাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী ও অনেক সাধারণ পথচারীর জীবন প্রদীপও। ব্যস্ত সড়কে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নেমে আসে নিস্তব্ধতা। আহতদের তীব্র আর্তনাদ এবং উপস্থিত মানুষের গগনবিদারী চিৎকারে কাঁচের টুকরার মতো ভাঙে নগরীর চাঞ্চল্য। এরপর ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকারীরা একে একে উদ্ধার করে ১৮ জনের লাশ। আহত হয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক। আহত অবস্থায় হাসপাতালে যান আরও মারা যান ৬ জন।
বিজ্ঞাপন
এমন বড় বড় বিস্ফোরণ ছাড়াও মাঝেমধ্যেই বাসা-বাড়িতে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের খবর পাওয়া যায়। এতে অনেকে হতাহতও হন। বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগ ঘটনাই এসি, রান্না ঘরের গ্যাস পাইপ লাইনে লিক কিংবা গ্যাসের লাইন ও সিলিন্ডার লিকেজের কারণে বদ্ধ ঘর গ্যাসের কূপে পরিণত হওয়া থেকে। প্রতিটি দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি আলাদা হলেও ঢাকার সায়েন্সল্যাবের কাছের ভবন, সিদ্দিকবাজারের ভবন এবং ২০২১ সালে মগবাজারের দুর্ঘটনাগুলো একই প্রকৃতির।
এভাবে নিয়মিত বিরতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণজনিত ঘটনা ঘটছে। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক তিনটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ তিনটি ঘটনার কোনোটির সঙ্গেই নাশকতা কিংবা পরিকল্পিতভাবে বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহারের আলামত পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদন্ত শেষে বিস্ফোরণগুলোর পেছনে ভবনগুলোর অভ্যন্তরে সৃষ্ট সমস্যাকেই দায়ী করেছেন। যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১২৪ জন। এছাড়া ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদাম বিস্ফোরণ থেকে লাগা আগুনে পুড়ে মারা গেছে আরও ৭১ জন। ঠিক একইভাবে কিছুদিন আগে আরমানিটোলায় মারা গেছে ৫ জন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার রানা প্লাজা ভবন ধসে ১১৩৮ জন শ্রমিক নিহত হন, যার অধিকাংশই ছিলেন ভবনটিতে থাকা গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক। প্রায় ২৪০০ শ্রমিককে ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করা হয়, যাদের অনেকেই অঙ্গহানির শিকার হন। তারা আজ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ আবার ভিক্ষাবৃত্তিও করছেন।
তাজরীন ফ্যাশন আর রানা প্লাজার দাগ শুকাতে না শুকাতেই রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানা, বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড, সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, সীমা অক্সিজেন প্লান্টের বিস্ফোরণ। এসব বিস্ফোরণের ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছেন, যারা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাদের পরিবার-পরিজন আজ কী অবস্থায় আছেন? প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষের কেউ কি তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন? না, নেননি। এলপি গ্যাসের বহু কারখানা আছে বাংলাদেশে। এই এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের ব্যবহার হচ্ছে অরক্ষিত যানবাহনে। প্রতিটি সিলিন্ডার যেন চলন্ত বোমা। এ জন্য যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। গণমাধমে প্রকাশ- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর রিটেস্টের নিয়ম থাকলেও অনেকেই তা করেন না। বিশেষ করে ভারী যানবাহনে সিলিন্ডার লাগানোর পর তারা রিটেস্ট করাতে চান না। তাদের ঝুঁকি বেশি। যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি বেশি থাকে। বড় কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে নিয়ম মেনে সবাইকে যানবাহনের সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্ট করানো উচিত।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের যত কলকারখানা, গার্মেন্টস আছে সবগুলো নিয়ে একটা তদন্ত প্রয়োজন। যাতে সেই তদন্তের ভিত্তিতে সরকারের বিভিন্ন দফতর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। যারা মধ্যযুগীয় কায়দায় কারখানা পরিচালনা করেন তাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা আর সীমা অক্সিজেন প্লান্ট, বিএম কন্টেইনার, তাজরীন ফ্যাশনস, রানা প্লাজা, নিমতলীর মতো ঘটনা দেখতে চাই না। প্রতিবার প্রাণহানির পর তদন্তে বেরিয়ে আসে হাজারো অনিয়ম আর অবহেলার কথা। গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের ক্ষেত্রেও একই রকম। তদন্ত হবে। বেরিয়ে আসবে নানা অনিয়ম। কিন্তু সেই তদন্ত আর আলোর মুখ দেখবে না। হয়তো বা অপরাধীরা পারও পেয়ে যাবেন।
অনাকাঙ্ক্ষিত এই প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি এড়াতে সবার সচেতনতা ও সতর্কতা জরুরি। তৎপরতা বাড়াতে হবে তদারকি সংস্থাগুলোকে। বিশেষ করে সেপটিক ট্যাংক, এসি, গ্যাসের লাইন, গাড়ি ও বাসার সিএনজি সিলিন্ডার, কারখানার বয়লার ও রাসয়নিক গুদাম রক্ষণাবেক্ষণে মানুষকে আরও মনোযোগী হতে হবে। গ্যাস বিক্রয় ও ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ভবনে গ্যাসজাতীয় দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন- পুরোনো গ্যাসলাইনগুলো শনাক্ত, মেরামত বা প্রতিস্থাপন করা, গ্যাস রাইজার লিকেজ নিয়মিত পরীক্ষা করা। গ্যাসে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত করা, যাতে লিকেজ হলে সহজে শনাক্ত করা যায়। ভবনবাসীর জন্য পুরোনো পাইপলাইন মেরামত ও নিয়মিত লিকেজ পরীক্ষা করা, বদ্ধ জায়গায় গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্তে গ্যাস সেন্সর ও অ্যালার্মের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তা না হলে বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে। অনেক মানুষ মারা যাবে। তদন্ত কমিটি হবে। তারপর আর খোঁজ থাকবে না। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম কন্টেইনার ডিপোর দুর্ঘটনার জন্য কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। দিনের পর দিন এভাবে চলে কিভাবে- এ প্রশ্ন আমাদের।
এসব কারখানার কাজে অসাবধানতা, উদাসীনতা, অদক্ষতা বা সতর্কতার বিষয়টির ওপর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোর দেয়া জরুরি। নতুবা বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। এছাড়া সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হই, তাহলে অনেক দুর্ঘটনা কমে যাবে। এ ছাড়া পরিত্রাণের কোনো সম্ভাবনা আছে বলে জানা নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

