বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

মুদ্রাস্ফীতি যেভাবে ব্যাংকের আমানত হ্রাস করে

বদরুল মিল্লাত ইবনে হান্নান
প্রকাশিত: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৬:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

মুদ্রাস্ফীতি যেভাবে ব্যাংকের আমানত হ্রাস করে

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যার ভুক্তভোগী আমরা সবাই। যুদ্ধ সবকিছুর হিসাব-নিকাশ এলোমেলো করে দেয়। এখন কোনো দেশ থেকে কোনো পণ্য আমদানি করতে গেলে কোন দেশ আবার নারাজ হয়- এসব হিসাব-নিকাশও করতে হয়। তবে হিসাব-নিকাশ যাই হোক, চূড়ান্ত ভুক্তভোগী আমরা। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষ। অবশ্য দামবৃদ্ধির জন্য যুদ্ধই একমাত্র কারণ নয়। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ চেইন ব্যাঘাত, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কট, টাকার অবমূল্যায়ন এর মধ্যে অন্যতম।

আমাদের দেশে সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু হয়। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেন তাদের নিজস্ব সমুদ্রবন্দরগুলো ধ্বংস করে দেয়। যাতে রাশিয়া থেকে আসা কোনো জাহাজ ইউক্রেনের বন্দরে ভিড়তে না পারে। এর ফলে ইউক্রেনে উৎপাদিত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকারক দেশগুলোতে পাঠানো যায়নি। ফলস্বরূপ সরবরাহ চেইন ভেঙে যায় এবং পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। যেহেতু সরবরাহ চেইন স্বাভাবিককরণ একটি অনিবার্য বিষয়, এটি ব্যহত হলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির উচ্চপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


বিশ্বের ছয়টি স্থানকে রুটির ঝুড়ি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা কৃষি পাওয়ার হাউস হিসাবে পরিচিত। এই ছয় স্থানে কোনো অস্থিরতা দেখা দিলে তার জন্য কমবেশি পুরো বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই রুটির ঝুড়িগুলির মধ্যে একটি রাশিয়ান-ইউক্রেন অঞ্চল।

আমরা সবাই জানি, এই ছয়টি অঞ্চলের একটি এখন যুদ্ধে লিপ্ত। রাশিয়ার মধ্যবর্তী একটি অঞ্চলের নাম সেন্ট্রাল ব্ল্যাক আর্থ রিজিওন। প্রচুর পরিমাণে অ্যামোনিয়া ও ফসফেট থাকার কারণে এই অঞ্চলটি অত্যন্ত উর্বর। এ কারণেই এখানে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যসশ্য উৎপাদিত হয়।

ইউক্রেনীয় অঞ্চলে ২০২২ সালের এপ্রিল-মে এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে কোনো ফসল উৎপাদিত হয়নি। তাই সমস্যা আরও তীব্র হচ্ছে।

আবার অনেক দেশ খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনের জন্য সারের উপর নির্ভরশীল। সার সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে ইউক্রেন ও রাশিয়া। কৃষি পাওয়ার হাউসের একটি নাম ব্রাজিল। খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন সারের। যথাসময়ে সার যথাযথ পরিমাণে ব্যবহার করতে না পারলে ভালো ফসল পাওয়া যায় না। ব্রাজিল যেহেতু প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শস্য উৎপাদন করে, সারের স্বল্পতার জন্য ব্রাজিল কাঙ্খিত মাত্রায় কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে পারেনি। ব্রাজিল যেহেতু রাশিয়া ও ইউক্রেনের সারের উপর নির্ভরশীল, তাই বাধ্য হয়ে ব্রাজিলসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোকে উচ্চমূল্যে অন্য দেশ থেকে সার আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


এদিকে সার রপ্তানিকারক দেশগুলোও সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে ও বাধ্য হয়ে বিক্রতারা পণ্যের বিক্রয়মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে পণ্যের বিক্রয়মূল্য বৃদ্ধি পায়, যা মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বাড়ায়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) গত বছর জ্বালানির দাম ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া হলো বিপিসিকে প্রথমে দামবৃদ্ধির জন্য এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব করতে হয়। বিইআরসি গণশুনানির ব্যবস্থা করবে। গণশুনানির মাধ্যমে যে মূল্য নির্ধারণ করা হবে তাই হবে ভোক্তা পর্যায়ের মূল্য।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন অ্যাক্ট-২০০৩ অনুযায়ী, বিইআরসি আইনের ৩৪ (১) ধারা, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, পাইকারি, বাল্ক ও খুচরা বিদ্যুতের দাম এবং সরবরাহ, ভোক্তাস্তরে জালানির দাম, সরকারের সাথে পরামর্শ করে কমিশন কর্তৃক প্রণীত নীতি ও পদ্ধতি অনুসারে নির্ধারণ করা হবে।

ধারা ৩৪ (৪) আরও বলে যে কমিশন ‘লাইসেন্স গ্রহীতা এবং এতে আগ্রহ আছে এমন অন্যদের শুনানির পর ট্যারিফ নির্ধারণ করবে’। ধারা ৪২ অনুযায়ী আইন লঙ্ঘনের জন্য তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫০০০ টাকা জরিমানা বিধান রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে জ্বালানির দাম বাড়ানোর অত্যাবশ্যক ছিল? আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) কোনো মূল্য কমানো ছাড়াই বিপুল মুনাফা করেছে।

কর্তৃপক্ষ দুদিক থেকেই জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করছে। জ্বালানি তেল বিক্রি হতে বিপিসি ৩০%-৩২% শুল্ক আদায় করছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে দরপতনের পরও দর না কমায় দীর্ঘদিন ধরে বিপিসি লাভ করেছে।

GlobalPetrolPrices.com অনুযায়ী জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের তিন ধরনের প্রক্রিয়া রয়েছে- (১) বাজার-নির্ধারিত খুচরা জ্বালানির দাম, (২) মূল্য সিলিং, (৩) নির্দিষ্ট মূল্য।

তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ নির্দিষ্ট মূল্য পদ্ধতি অনুসরণ করে। ডেইলি স্টারের এক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানি উপেক্ষা করে সরকার বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে মূল্য ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এই বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে। ৮ জানুয়ারি একটি শুনানির সময় বিইআরসির প্রযুক্তিগত (টেকনিক্যাল) মূল্যায়ন কমিটি খুচরা বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে। শুনানির ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিইআরসিকে নতুন মূল্য ঘোষণা করার কথা ছিল।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলছেন, প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হবে। জ্বালানির দাম ও বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি জনসাধারণকে ভোগান্তিতে ঠেলে দিয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামের এই ক্রমবর্ধমান প্রবণতা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতাকে বৃদ্ধি করেছে।

বিশ্ববাসী দেখেছে আফগানিস্তান ও রাশিয়ার রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরমধ্যে রয়েছে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলার যা রাশিয়ার জিডিপির ৩৫ শতাংশের সমান। এটি অন্য দেশগুলোর জন্য একটি বড় শিক্ষা। এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ মার্কিন ডলারে রিজার্ভ রাখতে অনেক কিছু বিবেচনা করবে। কারণ যদি মার্কিন ডলারে রিজার্ভ রাখা হলে ভবিষ্যতে যেকোনো সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলি রিজার্ভের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ গত বছরে তিনবার সুদের হার বাড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দেশটির জনগণ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে দায়ী করছে। কিন্তু ফেডের সুদের হার বৃদ্ধি এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বেশি হওয়া শুভ লক্ষণ নয়। যদিও এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্ত এতে করে কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম ছাড়াই মিথ্যা তথ্য দিয়ে বেশি লাভের আশায় সুযোগসন্ধানী ও কালো টাকার মালিকরা দেশ থেকে মানি লন্ডারিং ও হুন্ডির মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো দেশে অবস্থিত আমেরিকা বা আমেরিকান ব্যাংক বা মার্কিন সমর্থিত ব্যাংকগুলোতে অর্থ স্থানান্তর করার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখে।

আরেকটি উল্লেখযগ্যো বিষয় হলো মার্কিন ডলারের বিপরীতে আমাদের মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন। গত বছরের ১০ আগস্ট কার্ব মার্কেটে ইতিহাসের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে এবং এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১১৯.৯০ টাকায় পৌঁছেছে। সরবরাহ চেইন বিঘ্ন না ঘটলে, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি না হলে, যুদ্ধ-বিগ্রহ না হলে, বৈশ্বিক ডলার সঙ্কট দেখা না দিলে শুধুমাত্র টাকার অবমূল্যায়নের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি মানে দাম বেড়ে যাওয়া। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ফলে, অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, যার ফলে একই পণ্য কিনতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং মুদ্রাস্ফীতি জিডিপিকে কমিয়ে দেয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ফলে বিনিয়োগ আকাঙ্খিত মাত্রায় হয় না, কারণ এটি বিনিয়োগের ক্ষেত্রের জন্য অনিশ্চতয়তা তৈরি করে এবং এটি আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করে। যার ফলে রপ্তানির জন্য উৎপাদিত পণ্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। যার ফলে রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত আয় আরও কমে যায় এবং অনেক সময় কোনো আয় ছাড়াই পণ্য রপ্তানি করতে হয়। ফলে জিডিপি আরও কমে যায়। সুতরাং এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মুদ্রাস্ফীতির সাথে জিডিপির সম্পর্ক নেতিবাচক। অবশ্য ফিলিপস কার্বরেখায় এর ব্যতিক্রম দেখা যায়- উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বেকারত্বের নিম্ন হারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।

মুদ্রাস্ফীতির এই বৃদ্ধির প্রবণতা জনগণকে আরও বেশি পরমাণে নগদ টাকা হাতে রাখতে বাধ্য করছে। কারণ মানুষ একই পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করছে।

বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) অনুসারে, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ডিসেম্বর ২০২২-এ ৮.৭১ শতাংশ এবং নভেম্বর ২০২২-এ ৮.৮৫ শতাংশ।

নিউএজ এক সংবাদে জানিয়েছে, দেশে ব্যাংকের বাইরে নগদের পরিমাণ জুলাই মাসে রেকর্ড ২,৪২,০২৬ কোটি টাকা বেড়েছে। কারণ জনগণ ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে তাদের হাতে নগদ টাকা রাখতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে যে, এপ্রিল ২০২২ এ ব্যাংকের বাইরে নগদ সবচেয়ে বেশি ছিল যখন তা ছিল ২,৩৬,৭৯১ কোটি টাকা।

২০২২ সালের জুন মাসে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২,৩৬,৪৪৮ কোটি টাকা এবং যেটা ২০২১ সালের জুনে ২,০৯,৫১৭ কোটি টাকা। দেশের ব্যাঙ্কগুলির বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ ২০২২ সালের নভেম্বরে রেকর্ড ২,৫২,৯৮২ কোটি টাকা।

একই পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করাই দেশের সব ব্যাংকের আমানত হ্রাসের মুল কারণ।

লেখক: মো. বদরুল মিল্লাত ইবনে হান্নান, এমপিএ, অ্যাকাউন্টিং & ইনফরমেশন সিস্টেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সার্টিফাইড ফাইন্যান্সিয়াল কনসালটেন্ট (সিএফসি, আইএফসি, কানাডা), এসিসিএ (ফাইনাল লেভেল)। বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। ইমেইল[email protected]

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর