শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শাহবাগের গণজাগরণ: সেদিনের কথা

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

শাহবাগের গণজাগরণ: সেদিনের কথা

সেদিন ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। দুপুর থেকে ফেসবুক ভীষণ সরব। এরকম সরবতা কালেভদ্রে দেখা যায়নি৷ চেনাজানা সবাই লিখে যাচ্ছে—আন্দোলনের একটা প্রস্তুতি দাঁড় করাচ্ছে। আমিও খুব মুখিয়ে উঠছিলাম এরকম একটা আন্দোলনের৷ আমার শৈশব-কৈশোরের পুরোটাই অতিবাহিত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে।

নোয়াখালী জিলা স্কুলে পড়বার কথা মনে পড়ে, ক্লাস সেভেনে থাকতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পোস্টার লাগাতে গিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়তে হয়েছে। ছাড়পত্র (টিসি) দেওয়ার আয়োজনও ছিল সেই রোষানলে। এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকবো?


বিজ্ঞাপন


দুই.

বিকেলে পল্টনে আমাদের একটা মিটিং ছিল। তখন আমি যুব ইউনিয়ন ঢাকা মহানগরের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। সেই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম—আমরা শাহবাগের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানাবো। ইতোমধ্যে যুব ইউনিয়নের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।

মিটিং সেরে বাসায় এলাম। এরমধ্যে আমার ফুফাতো ভাই অধ্যাপক আবদুল জব্বার খান (বর্তমানে বুয়েটের উপ-উপাচার্য) জানালেন, শাহবাগে যাচ্ছেন তিনি। এটা জানা পর আমরা ঘরে থাকার কোনো চিন্তাই করলাম না। আমরা তিন ভাই শাহবাগে চলে গেলাম। স্লোগানে-স্লোগানে একাত্ম হয়েছি। ছোট ছোট মোমবাতি নিয়ে স্লোগানে গলা মেলালাম। পোস্টার লিখতে বসেছি।

তিন.


বিজ্ঞাপন


২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এই রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সেদিন বিকেলে কিছু অনলাইন অ্যাকিভিস্ট শাহবাগে জড়ো হয়। স্বল্প সময়ের আহবানে প্রথমে কয়েকশ ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট শাহবাগে জড়ো হন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ভিড় বাড়তে থাকে। অনলাইনে অব্যাহত প্রচারণায় ধীরে ধীরে মানুষের স্রোত জনসমুদ্রে রূপ পেতে থাকে।

শাহবাগে জড়ো হওয়া অনলাইন অ্যাকিভিস্টরা ভেবেছিলেন যে শুধু ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, রাজপথে দাঁড়িয়ে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ করতে হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করতে হবে।

চার.

বুকের মধ্যে একটা আগুন ছিল—বারুদ জ্বলা আগুন। ওই আন্দোলনে কেমন করে যেন সেই বারুদ জ্বলে উঠল, মুহূর্তে টেনে নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। ওইসময়ে যদি বেঁচে থাকতাম, নির্ঘাত যুদ্ধে যেতাম৷ আবেগটা সেই লেভেলের ছিল।

শাহবাগের গণজাগরণ আমাদের কাছে কেবল নিছক আন্দোলন ছিল না। অনেকগুলো ভিতে্র, নানা মাত্রিকতার মিথস্ক্রিয়া তৈরি করেছিল সেই আন্দোলন। একদিকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিল এ আন্দোলনে, অন্যদিকে ছাত্র-যুবদের শ্রেষ্ঠতম আন্দোলনে পরিণত হয়েছে৷ আর বৌদ্ধিক আন্দোলনেও ‘শাহবাগ’ নতুন মাত্রা তৈরি করে গেছে৷

এ আন্দোলন নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনাও আছে। কিন্তু এ আন্দোলনের প্রেক্ষিত সর্বজনীন।

আমার ছোট্ট জীবনে এ আন্দোলন সবসময়ে স্মরণীয়। গর্বিত হই—এ আন্দোলনে আমি একজন সাধারণ কর্মী ছিলাম।  

পাঁচ.

ওই সময়গুলোতে প্রচুর ঝড় গেছে আমাদের ওপর। প্রতিনিয়ত আমাদেরকে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। আমাদের অনেক সহযোদ্ধা নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। বিভিন্ন হুমকির শিকার হতে হয়েছে। তবুও দুর্বিনীত ছিল। ভেঙে পড়েনি। লড়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। আমি তাদের শ্রদ্ধা জানাই, সম্মান জানাই। মাঝে মাঝে আমাদের ঠিকানা বদল করতে হয়েছে। তবুও আমরা কাঁধে কাঁধ রেখে একসঙ্গে ছিলাম। পালিয়ে যাইনি।

ছয়.

শাহবাগ চত্বর—পুরনো ঢাকা থেকে নতুন শহরের দিকে আসা অজস্র গাড়ি আর সাইকেল রিকশায় জমে থাকে। মাঝে মাঝে ভিড় একটু হালকা হলে চোখে পড়ছে, রাস্তার প্রস্থজুড়ে সাদা রং দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—গণজাগরণ মঞ্চ। রঙ কোথাও কোথাও সামান্য ফিকে হয়ে গিয়েছে। এই সেই চত্বর, যেখানে ১০ বছর আগে লক্ষাধিক মানুষ বহু দিন কাটিয়েছেন। তাদের আন্দোলন গোটা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছে। আজ কোথায় সেই আন্দোলনের গতিপথ? তবে কি রাস্তাজোড়া বর্ণমালার সাদা রঙের মতোই আন্দোলনও ফিকে হয়ে গেল? নাকি, আপাতত আগামী বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে?

sahbag

গ্রামের মানুষদের কাছে শাহবাগ আন্দোলন তেমন কোনো বড় বিষয় নয়। শহরের গরিব মানুষও যে এর সঙ্গে খুব বেশি একাত্ম হয়েছিলেন, এমন নয়। কিন্তু এটা যদি আন্দোলনের ব্যর্থতা হয়, তবে এক অর্থে এটাই তার সাফল্যের চাবিকাঠি। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধের পরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ধরনের ঐক্য আর কখনও নজরে আসেনি।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি হাতেগোনা ‘১০ থেকে ২০ জন’ নিয়ে যে আন্দোলনের শুরু, কেমন করে কয়েক ঘণ্টায় হাজার, কয়েক দিনে হাজার পেরিয়ে লাখে পৌঁছল, তা ইতিহাস। এবং তারা কারা? যারা বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম, ভবিষ্যতের কারিগর। শাহবাগ ব্যর্থ না সফল, তা সময়ই বলবে। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি যে, আমাদের প্রত্যেকের মনে একটা করে শাহবাগ তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজন হলেই আবার সেই লুকোনো শাহবাগ বেরিয়ে আসবে।

আন্দোলনের গোড়ার দিকে প্রায় কুড়ি দিন ও রাত একটানা শাহবাগে জমায়েত করেছিলাম। সে একটা অদ্ভুত অবস্থা। হাজারে হাজারে স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ রাস্তায় বসে আছে। কী খাবে, কোথায় থাকবে, কোনো চিন্তা নেই। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট দাবিপূরণ চাই। কিন্তু এমন করে তো বেশি দিন চলতে পারে না। অনেকে বাইরে থেকে চাকরি ছেড়ে, দোকান ফেলে এসেছেন। জানেন না চাকরি রইল কি না, দোকান কী অবস্থায়। সাধারণ মানুষ তো এগিয়েছে। ভাবা যায়, শাহবাগের জমায়েতে যাবে শুনলে রিকশা চালকও সওয়ারির কাছ থেকে ভাড়া নিতে চাননি। বিনা পয়সায় গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন!

সারা দিন ও রাতের বদলে আন্দোলনকে ৩টা থেকে ১০টা অবধি নির্দিষ্ট করা হলো। তারপর অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে মানুষকে সাত দিনের একটা সীমা ধার্য করে ফেরত পাঠানো হলো। জমায়েত প্রত্যাহৃত হলো। সরকারও বেশ কিছু দাবি মেনে নিয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীসংক্রান্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিষয়ক ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের আইনি পরিবর্তন। ফলশ্রুতিতে আন্দোলন-পরবর্তী যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে যে রায়গুলো হয়েছে, সেগুলো অনেক সুসংহত ও যথাযথ।

আর একটা ব্যাপার ছিল। শাহবাগ আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ রূপে অহিংস। এত দিনের আন্দোলনে একটা মানুষকেও কেউ ধাক্কা দেয়নি বা গাড়িতে ইট মারেনি। অ্যাম্বুলেন্স যাতে সহজে যাতে দ্রুত পার হতে পারে, সেই ব্যবস্থা আমাদের নেতাকর্মীরা করে দিয়েছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত রাখার জন্য সংগঠকদের সারাক্ষণ নজর রাখতে হতো, সেটা করতে গেলে আগামী আন্দোলনের রূপরেখা বানানো সম্ভব হতো না—বহু দিন ধরে রাস্তা বন্ধ করার অভিযোগ উঠুক, এটাও আমরা চাইনি।

সাত.

এটা মানতে হবে, গণজাগরণ মঞ্চে একটা সময়ে বিভেদ তৈরি হয়েছে। তার কারণও আছে। বিভেদ তৈরির মূল কারণ হচ্ছে, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে বিভিন্ন ধরণের মানুষ এসেছেন। এখানে ইতিহাস দায়বদ্ধতা মেটাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানুষ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন—সকলেই এসেছেন। যারা এসেছিলেন, তারা একটাই ইস্যু ছিল, যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক জায়গা থেকে যারা এসেছিলেন, তাদের প্রত্যেকের দলীয় রাজনীতির একটা যুক্তি তার কাছে ছিল। তিনি যখন দেখছেন, তার চিন্তাধারার সাথে শাহবাগ ক্ল্যাশ করছে, তখন তিনি সরে গেছেন। তবে শাহবাগ আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে সরকার আন্দোলনটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ফলে আস্তে আস্তে গণজাগরণ মঞ্চের বিভেদগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। 

লেখক: সাংবাদিক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর