বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

তুষারে রুশদের দিনলিপি

মো. নাহিদুজ্জামান
প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

তুষারে রুশদের দিনলিপি

সকাল হয়েছে, কিন্তু এখনও আলো ফোটেনি আকাশে। শীতকালে অন্ধকার শহরেই দিনের প্রথম যাত্রা শুরু হয় রুশদের। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং খারাপ আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে নিত্যদিনের জীবন-যাপন কেটে যায় তাদের দিব্যি। তুষারে ঢাকা এই শহর পরিণত হয় এক সাদা মরুভূমিতে।

অক্টোবর এর শেষ থেকেই শুরু হয়ে যায় শীতকে আগমন জানানোর উৎসব। প্রতিদিন একটু একটু করে কমতে থাকে দিনের দৈর্ঘ্য আর ঘনিয়ে বড় হয় রাত। এইতো গত গ্রীষ্মে যেই সবুজ পাতাগুলো চোখকে আরাম দিয়েছে, সেই চোখেই দেখতে হয় এদের হলুদ হয়ে ঝরে যাওয়ার অপরূপ বেদনার দৃশ্য। গ্রীষ্মকালে রুশরা ছুটি কাটায় দেশে বিদেশে, আর তুষারের দিনগুলোকেই এর বেছে নেয় কর্মজীবনের জন্য। 


বিজ্ঞাপন


সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রুশদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে প্রতিযোগী মনোভাব। যদিও রুশ নাগরিকরা কিছু না করলেও কোনো রকম জীবন-যাপন করার ব্যবস্থা করা আছে সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা এবং ব্যস্ততা যেন তাদের বিষন্নতা কাটানোর প্রথম হাতিয়ার।

russia

ডিসেম্বরের সকাল, ভোর ৫টায় দেখতে পাওয়া যায় এক গুচ্ছ মানুষ জমাট বেঁধে আছে বাসস্ট্যান্ডে। মানুষগুলোর বেশির ভাগেরই প্রথম গন্তব্য স্থল মেট্রো। সকাল ৫টায় প্রথম মেট্রো ছেড়ে যায় স্টেশন এবং ছুটে চলে শহরের আনাচে কানাচে মধ্যরাত ১টা পর্যন্ত। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত অথবা ধনী সকলের পছন্দের বাহন মেট্রো। মেট্রোতে প্রবেশ করলে বোঝার উপায় নেই বেইরে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 

এছাড়া অল্প দূরুত্বগুলোর জন্য বাসই যথেষ্ট। সবার ঘুম ভাঙার আগেই পরিষ্কার করা হয়েছে সারা রাতের যমে যাওয়া তুষার। তারপরও পিচ্ছিল রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য, শীত আসার সাথে সাথেই বদলে গেছে সকল টায়ার। যেকোনো শহরের ঘর, অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় অথবা শপিংমল সকল স্থাপনায় উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। দেশের আকারের তুলনায় জনসংখ্যা কম বলে শহরগুলোতে রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা। শহরজুড়ে গড়ে উঠেছে সুপরিকল্পিত স্থাপনা। শীতের দিনগুলোতে তাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছাতে দেখতে পাওয়া যায় সুদীর্ঘ সাদা মাঠ, ধুসর আকাশ, বরফ জমা নদী আর তুষার গাছ। 


বিজ্ঞাপন


সারারাত যেদিন তুষারপাত হয় সেদিন পাতা ঝরে যাওয়া গাছগুলোর ডাল পালায় জড়িয়ে পরে তুষার। দূর থেকে দেখলে মনে হয় তুষার গাছে তুষার ধরেছে। ঘরের জানালা অথবা বাস বা মেট্রো কাচের জানালা থেকে যখন দেখা যায় আকাশ থেকে ধীরগতিতে সাদা সাদা তুলোর মতো বৃষ্টি পড়ছে তখন হেডফোনে সেমি রক জনরার গান লাগিয়ে ছুটে চলছে এক দল শিক্ষার্থী, যেন বিষন্নতা তাকে ছুঁয়ে না দিতে পারে। কর্মজীবনে যারা ভালো চাকরি করে তারা ঠাঁই পায় অফিসের ভেতরে। 

russia

অফিসের রুমে হালকা মেলোডীর গান অথবা রেডিওর প্লেলিস্ট লো ভলিওমে ছেড়ে  সেখানেই কাটে তাদের কাজের ব্যস্ততা। আর যাদের কাজ অফিসের বাইরে তাদের প্রস্তুতি সবার থেকে একটু অন্যরকম। রাস্তায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, বরফ জমা রাস্তা বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে না দিলেও তারা সবার থেকে বেশি অভিযোজন ক্ষমতাশীল। শীতবস্ত্র পরিধনে কোনো কার্পণ্য নেই তাদের, কাজের ফাঁকে রাস্তার শর্মার দোকানে অথবা সস্তা কোনো ক্যাফেতে গরম চা আর গরম গরম সামসা অথবা ভিপিচকি তাদের নিত্যদিনের ‘স্ন্যাক্স টু বি এলাইভ’ বলা চলে। এভাবেই যখন দিন কেটে যায় সবাই ছুটে চলে উল্টো দিকে।

রাশিয়ান ইতিহাস অনেক পুরানো এবং সমৃদ্ধ, হাজার হাজার বছর ধরে তারা এই ভূমিতে বসবাস করে এবং এই আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে আজ এতো উন্নত একটি দেশে পরিণত হয়েছে। এই আবহাওয়ার সাথে অভিজোযনের তাদের রয়েছে নিজেস্ব পদ্ধতি এবং দক্ষতা। সারাদিন ব্যস্ততার পর ঘরে ফিরে তারা এই ঠাণ্ডায় পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে নিয়ে পার্কে হাঁটতে যায়। এর মূল কারণ এডাপ্টেশন। ছোট বেলা থেকেই এখানে শিশুদের এমন কিছু শিক্ষায় বড় করে তোলা হয় যেন বড় হয়ে তাদের কঠিন সময়গুলো উপড়ে তারা পূর্ণাঙ্গ রুশ নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠে।

রুশদের খুবই পছন্দের পোষা প্রাণী হলো কুকুর। এরা কুকুরকে খুব ভালোবাসে এবং তাদের পরিবারের সদস্য হিসেবেই গণ্য করে। শীতের বিকেলে পরিবারের সাথে কুকুরকে নিয়েও এরা হাঁটতে বের হয়। বাচ্চারা মেতে উঠে তুষার মানব তৈরির পেছনে আর অভিভাবকেরাও তাদের উৎসাহ দেয়। শহরের জায়গায় জায়গায়  ব্যবস্থা করা হয় আইস স্ক্যাইটিং ফিল্ড। যেখানে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই তাদের দক্ষতা ঝালাই দেয় প্রতি বছর। দিন ছোট হওয়ার কারণে যেন জীবনের আমেজটা ছোট না হয়ে যায়, সেজন্য শহরকে সাজানো হয় সাদা-হলুদ, লাল-নীল বাতিতে। সারারাত শহরে জ্বলে থাকে এই সব বাতি। এই শহর যেন কখনো ঘুমায় না। এ যেন বিষন্নতার মাঝে উৎসবের উষ্ণতা।
 
লেখক 
মো. নাহিদুজ্জামান
মাস্টার্স, ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট
পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি
মস্কো, রাশিয়া

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর