শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

পাঠ্যবই নিয়ে এত অবহেলা কেন?

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৬:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

পাঠ্যবই নিয়ে এত অবহেলা কেন?

তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব। উক্তিটি করেছিলেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। বোনাপার্টের উক্তি অনুসারে গোড়ায় গলদ থাকলে আমরা শিক্ষিত জাতি কোনোক্রমেই আশা করতে পারি না। শিক্ষিত জাতি পেতে গেলে নির্ভুল পাঠ্যবই পেতে হবে। কিন্তু সেই পাঠ্যবই নিয়েই বর্তমানে চলছে টালবাহানা। পাঠ্যবইয়ে বিভ্রান্তিকর এবং উস্কানিমূলক পাঠ, ছবি এবং প্রচ্ছদের দায় নিয়ে চলছে নানা পর্যালোচনা। এমনকি সাধারণ জনগণ থেকে শুরু উচ্চমহল পর্যন্ত চলছে আলোচনা সমালোচনাও।

পাঠ্যবইয়ের ভুল নতুন কিছু নয়। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে এবারের ভুলটা আরও ভয়াবহ। বারবার পাঠ্যবই নিয়ে এত অবহেলা কেন? পাঠ্যবই সম্পর্কে বেশ আগে থেকেই রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। প্রতিটি নতুন বছরের প্রথম দিনে সব বই হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীরা উৎসবে মেতে ওঠে। এবারে তাও হয়নি। নিম্নমানের কাগজ, ছাপা নিম্নমানেরসহ বহু ধরনের অভিযোগ নিয়ে নতুন বই এসেছে, তাও পুরোটা নয়।


বিজ্ঞাপন


জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ও প্রেস একদল আরেক দলের ওপর অভিযোগ চাপিয়ে দায় মুক্তির চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারপরও অভিযোগের বিষয়টি একদম আলাদা। এবারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক সরবরাহ করা বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল পাওয়া গেছে। কোনো বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুল, কোনো বইয়ে ভুল হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে। বানান ভুল তো আছেই। বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে এনসিটিবি। তারা জানেও না এসব ভুলের দায় কার।

কেউ কেউ মনে করেন, বইয়ের পাঠে যা যাচ্ছে, তার দায় লেখকদের। ভুলের কারণ হিসেবে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন এনসিটিবির সক্ষমতা নিয়ে। প্রতিটি পাঠ্যবই রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকেন প্রথিতযশা লেখক, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা তৈরি হয়, তা দেখে বিস্ময় জাগে, শিক্ষার ভিত্তিস্তরে এত ভুল, বিকৃতি, নিম্নমান থেকে যায় কী করে?

প্রশ্ন জাগে, পাঠ্যবইয়ে কি তবে লেখক ও সম্পাদক হিসেবেই তাদের নাম ব্যবহৃত হয়? বাস্তবে লেখা ও সম্পাদনার কাজ অন্য কেউ করে দেন!

পাঠ্যবইয়ের ভুল নতুন না হলেও এবারে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিরাও যে পাঠ্য বইয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামান্য গুরুত্ব দেয় না সেটা পরিষ্কার হয়েছে। শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবই তাদের ভেতরে ছাপ ফেলে। তারা ভুল পড়লে ভুল শিখবে। এই ভুল শিক্ষা যদি নৈমিত্তিক হয় তাহলে জাতির একটি বড় অংশ বেড়ে উঠবে ভুল শিক্ষা নিয়ে। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।


বিজ্ঞাপন


এবারের পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্যে ভুলে ভরা। বিভিন্ন রকমের কথা বলে নিম্নমানের ছাপায় পাঠ্যবই ছাপানোর পরেও একের পর এক ভুল বের হচ্ছে। অজস্র ভুল ও অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য দিয়ে পাঠ্যবই ছাপানোয় উদ্বিগ্ন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুস্তক প্রণয়নে অযত্ন ছিল। বই লেখা ও সম্পাদনায় অসতর্ক ছিলেন লেখক-সম্পাদকরা। আর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ছিল। ফলে বইয়ের লেখক, সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর দায় এড়াতে পারেন না।

যদিও এনসিটিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বইয়ের ভুল থাকার মূল দায় লেখক ও সম্পাদকের। যাদের বইয়ে বড় ধরনের ভুল পাওয়া গেছে, আগামীতে তাদের আর এনসিটিবির লেখকের তালিকায় রাখা হবে না। প্রয়োজনে তাদের কাছে এসব ভুলের জন্য কৈফিয়তও তলব করা হবে, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছর প্রকাশিত নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি বড় ভুল ধরা পড়েছে। এখানে বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। অথচ এখানে হবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে। ওই বইয়ের ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মাদ সায়েমের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অথচ বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়ান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এছাড়া বইটির ২০২ নম্বর পৃষ্ঠায় সংবিধান প্রণয়ন ও পটভূমিতেও অনেক তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে।

নবম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ‘ক্যাম্প’ ও পিলখানা ইপিআর ‘ক্যাম্প’ ছাপা হয়েছে। অথচ এখানে হবে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর। একই বইয়ের ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ৫৪ সালের নির্বাচনে চারটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো ৫৪ সালের নির্বাচনে পাঁচটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়।

একই বইয়ের ২৮ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো, সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার অধিকার সংরক্ষণ এ সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য। নবম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের ৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কাজ অংশের ১ নম্বর অনুচ্ছেদেও প্রকৃত তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে। একই বইয়ের ৫৯ পৃষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কাজের বিষয়েও অসঙ্গতি তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করা হয়েছে। এই অভিযোগ সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান। তারা এর দায়ও স্বীকার করেছেন। তবে এই লেখাটি এই দুই জন লেখেননি বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন। তাদের টিমের অন্য কেউ লিখেছেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। তবে এই অন্য কেউরা কারা। তাদেরকে চিহ্নিত করা হোক।

বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান পাঠ্যবইয়ে এত বড় ভুল ধরতে পারলেন না কেন? নাকি তাদের দায়িত্ব পালনে গাফলতি ছিল। তারা যদি এত বড় ভুল করেন তাহলে বর্তমান প্রজন্ম তাদের কাছ থেকে কী শিক্ষা নেবেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানতে পারলাম তারা এই ভুলের জন্য দায় স্বীকার করেছেন। এত বড় ভুলের জন্য শুধু দায় স্বীকার করলেই কি মাফ পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ক্ষেত্রে বিব্রত ও লজ্জিত হওয়াটাই কি যথেষ্ট! এর চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এনসিটিবি কি সব দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে?

কারিকুলাম অনুযায়ী বই লেখার জন্য লেখক নির্বাচিত করা হয়। বিষয়ভিত্তিক ‘প্রথিতযশা’ বরেণ্যদের দ্বারাই পাঠ্যবই লেখানো হয়। তাদের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয় বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে পাঠ্যগল্পের সামঞ্জস্য চিত্র। এসব কাজে এনসিটিবির হস্তক্ষেপ নেই। বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যবই তৈরির পর ত্রুটিবিচ্যুতি দেখার জন্য দেশের ‘প্রথিতযশা’ ব্যক্তিদের কাছে দেওয়া হয়। তারা দেখার পরেই চূড়ান্ত করা হয় বই। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে ‘প্রথিতযশাদের’ বই দিয়ে লাভ কী। ২০১৭, ২০২০ ও ২০২১ সালেও নানা ধরনের ভুল সংশোধন করার পরেও কীভাবে ভুল রয়ে গেছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।

অনেক বই এখনো শিক্ষার্থী, শিক্ষকরা পাননি। সময় যত গড়াবে বইয়ে অনেক ভুল আরও বের হবে। এসব ভুলের দায় নিয়ে শুধু সংশোধনী দিলেই চলবে না, সংশ্লিষ্ট লেখককে কালো তালিকাভুক্ত করে আজীবনের জন্য এনসিটিবিতে অবাঞ্ছিত করা উচিত। বইয়ের ভুলের জন্য লেখক, সম্পাদক ও এনসিটিবিও দায় এড়াতে পারে না। পাঠ্যবইয়ে দিনের পর দিন ভুল যায় কি করে, জবাবদিহিতার সংকটে এ ঘটনা ঘটছে বারংবার।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আত্মপরিচয়ের জায়গা, আমাদের জীবন ও অস্তিত্বের জায়গা। এখানে ভুল কিভাবে হয় সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি। শিশু-কিশোররা পাঠ্যপুস্তক থেকে ভুল ইতিহাস শিখলে সেটা আগামীর বাংলাদেশের জন্য খুবই দুঃখজনক। তাই এসব বই নির্ভুল করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর