শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কালেভদ্রে দেখা মেলে পালতোলা নৌকা

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৬:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

কালেভদ্রে দেখা মেলে পালতোলা নৌকা

আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে যান্ত্রিক যানবাহনের ভারে পালতোলা নৌকা হারিয়ে গেছে। নদীতে সারি সারি পালতোলা নৌকার সেই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। মাঝির কণ্ঠে আর শোনা যায় না সেই চেনা সুর- ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’

পালতোলা ওই নায়ের মাঝি/ভাটিয়ালি গায়/ঘোমটাপরা গাঁয়ের বধূ/শ্বশুরবাড়ি যায়। ও মাঝি ভাই ও মাঝি ভাই/কোন সে গাঁয়ে যাও/রূপগঞ্জে মামার বাড়ি আমায় নিয়ে যাও/আষাঢ় মাসে ভাসা পানি/পূবালী বাতাসে বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/আমারনি কেউ আসে।


বিজ্ঞাপন


মাঝিকে গাঁয়ের বধুর এমন আকুতি হারিয়ে গেছে। খালে-বিলে ও নদীতে নেই আর সেই মাঝি ভাইয়ের পালতোলা নৌকা। আছে শুধু সেই সব সোনাঝরা দিনের স্মৃতি বিজড়িত ছড়া, কবিতা আর গান।

বাংলাদেশে নদীমাতৃক দেশ। একসময় বর্ষাকালে প্রচুর পালতোলা নৌকা খাল-বিলে, নদী-নালায় চলাচল করত। নৌকার চালককে বলা হয় মাঝি। নদী আর নৌকা ছিল আমাদের গ্রাম জীবনের বহমানতা। বর্ষায় প্রকৃতি মানব হৃদয়ে রোমান্টিকতার যে সুর তুলে ধরে তা অন্য কোনো ঋতুতে মেলে না। নদীতে বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পানি থাকে। তাই কালেভদ্রে দেখা মেলে পালতোলা নৌকা। এছাড়া আর বাকি চার ঋতুতে নদী-নালা, খাল-বিল মরুভূমিতে পরিণত হয়।

পানিশূন্য হয়ে যায় নদীগুলো। যার কারণে গ্রাম্য সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেলচালিত ইঞ্জিন।

সময়ের বিবর্তনে জৌলুস হারানো নদ-নদীর করুণ অবস্থা আর যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ফলে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রামবাংলার লোক-সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক পালতোলা নৌকা। এক সময় সাম্পান, গয়না, একমালাই নৌকা, কোষা নৌকা, ছিপ নাও, ডিঙি, পেটকাটা নাও, বোঁচা নাওসহ বিভিন্ন ধরনের পালের নাওয়ের ব্যবহার ছিল। কালের আবর্তে পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা ভুলে যাবে, ‘পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও’ ইত্যাদি ছড়া। বিচিত্র রঙের পালের বাহারিতে ঝলমল করবে না এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল।


বিজ্ঞাপন


আহারে! আগে খালে-বিলে-নদীতে কত রকম নৌকা চলত। নাইয়রি নৌকা, পালতোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, সাপুড়িয়া নৌকা, ভোট নৌকা, পানসি নৌকা, বৌচোরা নৌকা, গয়না, লক্ষ্মী বিলাস, গণ্ডী বিলাস, বজরা, খেয়া নৌকা, কোসা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা, বাইচের নৌকা ও মহাজনী নৌকা। সেসব এখন জাদুঘরে। গ্রামীণ নৌকা জীবনে এসেছে যান্ত্রিকতা। এখন আর মাঝিকে গুণ টেনে নৌকা চালাতে হয় না।

নদী হারিয়েছে নাব্য। নদীতে ব্রিজ হয়েছে। বিলগুলো পানিশূন্য সারা বছর। জলাশয়গুলো বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। পালতোলা নৌকা চলবে কোথায়? তাই এখন শুধুই স্মৃতির জাবরকাটা।

দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল ঐতিহ্যবাহী পালের নাও। একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-ঝিল, এমনকি সমগ্র উপকূল জুড়ে নয়নাভিরাম শোভা বিস্তার করত বিচিত্র ধরনের পালতোলা নৌকা। ভাটির অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের সঙ্গেই ছিল নদী, সাগর আর পালের নাওয়ের নাড়ি ছেঁড়া সম্পর্ক।

পালের নাওকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন কত শত গল্প, কবিতা, ছড়া, পালাগান। চিত্রকর এঁকেছেন নান্দনিক শিল্পকর্ম। শুধু দেশি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী বা রসিকজনই নন বরং বিদেশিদের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পালের নাও।

হাতে গোনা দু’একটা পালের নাও বাদামি নাও চোখে পড়লেও নেই আগের মতো জৌলুস। এসব নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না। নববধূ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য পালতোলা নৌকার বায়নাও আর ধরে না।

BOAT

এই তো ১০-১৫ বছর আগেও পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদীর বুকচিরে বয়ে বেড়াত সারি সারি নৌকা। এসব নৌকায় ছিল রঙিন পাল। স্বচ্ছ পানির কলতান আর পালে লাগা বাতাসের পত পত শব্দ অন্যরকম অনুভূতি, জুড়িয়ে যেত প্রাণ। বিভিন্ন আকার ও ধরনের নৌকাই ছিল দেশের সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। আর এসব নৌকা চালানোর জন্য পালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুড়পাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে।

পালের নৌকার পাশাপাশি মাঝিদেরও বেশ কদর ছিল এক সময়। প্রবীণ মাঝিরা নৌকা চালানোর বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাদের হিসাব রাখতে হতো জোয়ার-ভাটার, বিভিন্ন তিথির এবং শুভ-অশুভ ক্ষণের। কথিত আছে, বিজ্ঞ মাঝিরা বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন ঝড়ের আগাম খবর। রাতের আঁধারে নৌকা চালানোর সময় দিকনির্ণয়ের জন্য মাঝিদের নির্ভর করতে হতো আকাশের তারার ওপর। তাই আগেভাগেই শিখে নিতে হতো কোন তারার অবস্থান কোন দিকে। নদ-নদীতে মাঝিরা নৌকার পাল উড়িয়ে দিয়ে ঢেউয়ের তালে-তালে উদাত্ত কণ্ঠে ভাটিয়ালি সুরের মূর্ছনায় মুখরিত করে তুলত দিক-দিগন্ত।

উদাস করা ভরদুপুরে এমন দৃশ্য আকৃষ্ট করত সবাইকেই। মাঝেমধ্যে দু’একটা পালের নাও এখনো নদ-নদীতে দেখা যায়। তবে এক সময় হয়তো হারিয়েই যাবে আমাদের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পালের নাও।

আগে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির ঘাটে সারি সারি পাল তোলা নৌকা বাঁধা থাকত। এখন যান্ত্রিক স্পিডবোট তার স্থান দখল করে নিয়েছে। এখনও নদীমাতৃক আমাদের জীবন-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। কিন্তু পানিশূন্যতা আমাদের সবকিছু পানসে করে দিচ্ছে। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। যান্ত্রিক যানবাহন হটিয়ে দিচ্ছে জীবন নির্ভর যানবাহনকে। শিকড় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে জীবন। সভ্যতার পালে লেগেছে হাওয়া। ছুটছে মানুষ দ্রুত। কোথায় যাচ্ছে এবং কেন যাচ্ছে তা কারো জানা নেই।

বর্ষার অপার শোভায় বিমোহিত হয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া...’। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন- ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাহি না আর...’।

বাংলার গানের পাখি কোকিলকণ্ঠ শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছেন- (ও) মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে..., ভাটিয়ালি সুরের শিল্পী আব্দুল আলীম গেয়েছেন- ‘নাইয়া রে নায়ের (নৌকা) বাদাম (পাল) তুইলা কোন দেশে যাও চইলা’।

বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিক যানবাহনের বহুল প্রচলনের আগে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদী আর নৌকা। যুগের হাওয়া লেগেছে পালে, দ্রুত থেকে দ্রুততর ছুটতে হবে আমাদের। তাই দ্রুত ছুটে যাচ্ছি আমরা মৃত্যুর দিকে, ধারণ করে চলছি যান্ত্রিক সভ্যতা। তাই পালতোলা নৌকাতে এখন আর আমাদের চলে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর