রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

অপারেশন সার্চলাইট দিয়ে শুরু হয়েছিল গণহত্যা

দীপংকর গৌতম
প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:১৫ এএম

শেয়ার করুন:

অপারেশন সার্চলাইট দিয়ে শুরু হয়েছিল গণহত্যা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। পাকিস্তান বাহিনী একাত্তরের ডিসেম্বরের শুরুতেই তাদের পরাজয়ের বিষয়টা বুঝতে পারে। তখন তারা পালিয়ে ঢাকা অভিমুখী হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে তারা গণহত্যা শুরু করে এবং এই গণহত্যা চালায় নয় মাস। এই নয় মাসের গণহত্যার সঙ্গে তারা সারাদেশে জন্ম দিয়েছে অজস্র গণকবর আর বিভৎস নির্যাতনের।

ঢাকায় এক রাতের যে অভিযানে অর্ধ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল, সেই রাতটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্ণনা করা হয় 'কালরাত্রি' হিসেবে। গণহত্যার মতো নারকীয় এক অঘটনের জন্ম দিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ওই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নাম বা কোডনেম দিয়েছিল 'অপারেশন সার্চলাইট'। এই অভিযানটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল তারও এক সপ্তাহ আগে, ১৮ মার্চ।


বিজ্ঞাপন


সময়টা ছিল রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের শহর। ঢাকায় ইতিমধ্যে ওড়ানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরই মধ্যে ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছেন। ডামি রাইফেল নিয়ে ঢাকার রাস্তায় মার্চ করছেন ছাত্রছাত্রীরা। ঢাকায় তখন চলছে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। আলোচনায় অংশ নিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোও রয়েছেন শহরে। সব মিলে খুবই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের পরিস্থিতি বিবেচনা করে এরকম প্রেক্ষাপটের যুক্তি ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা ‘ব্যর্থ’ হলে সামরিক অভিযান চালিয়ে ‘পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা করা হবে।

‘কালরাত্রির’ সেই ভয়াবহ সেনা অভিযানের পরিকল্পনা কীভাবে হয় তার ধারণা পাওয়া যায় সেসময় ঢাকায় দায়িত্বরত পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতিকথা থেকে। মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ শিরোনামের একটি স্মৃতিচারণমূলক বইয়ে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে পাঠান। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের উপদেষ্টা। দুইজন সেখানে যাওয়ার পর টিক্কা খান তাদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি হচ্ছে না। যে কারণে এখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশনে’র জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আর সে কারণে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ১৮ মার্চ সকাল থেকে ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাসায় রাও ফরমান আলী এবং তিনি দুইজন মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন।

খাদিম হুসাইন রাজা লিখেছেন, ১৮ মার্চ সকালে তিনি তার স্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন যাতে তিনি তার বাঙালি এডিসিকে ব্যস্ত রাখেন, এবং তার অফিস থেকে দূরে রাখেন। যেন রাও ফরমান আলী সকাল সকাল খাদিম হুসাইন রাজার অফিসে কী করছেন এমন সন্দেহ বাঙালি এডিসির মনে উদয় না হয়। সারা সকাল ধরে জেনারেল রাজা এবং জেনারেল আলী সামরিক অভিযান পরিচালনার খসড়া তৈরি করেন।অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দুইজন পরিকল্পনার পরিসর নিয়ে একমত হন, এরপর দুইজনে দুইটি আলাদা পরিকল্পনা লেখেন। ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অপারেশনের দায়িত্ব নেন রাও ফরমান আলী, আর বাকি পুরো প্রদেশে অভিযানের দায়িত্ব নেন খাদিম হুসাইন রাজা। রাও ফরমান আলী পরিকল্পনায় তার অংশে একটি মুখবন্ধ লেখেন, এবং কিভাবে ঢাকায় অপারেশন চালানো হবে তা বিস্তারিত লেখেন।ঢাকার বাইরে বাহিনী কী দায়িত্ব, কিভাবে পালন করবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন খাদিম। সন্ধ্যায় খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে তারা হাজির হন কমান্ড হাউজে। খাদিম হুসাইন রাজা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন এবং কোন আলোচনা ছাড়াই পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিদ্দিক সালিক। 'উইটনেস টু সারেন্ডার' শিরোনামের একটি বইয়ে তিনি 'অপারেশন সার্চলাইট' নিয়ে লিখেছেন, জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে ওই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, তিনি স্বচক্ষে সেই হাতে লেখা পরিকল্পনার খসড়া দেখেছিলেন। তাতে সামরিক অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, 'শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।' পরিকল্পনা অনুমোদিত হলেও কবে সামরিক অপারেশন চালানো হবে সেই দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল না।খাদিম হুসাইন রাজা তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ২৪শে মার্চ দুইটি হেলিকপ্টার নিয়ে রাও ফরমান আলী এবং তিনি নিজে ঢাকার বাইরে অবস্থানরত ব্রিগেড কমান্ডারদের সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশনা দিতে রওয়ানা হন। অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে বলেও ব্রিগেড কমান্ডারদেরকে জানানো হয়েছিল যে, আঘাত হানার সময় পরে জানানো হবে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব গ্যারিসনকে একই সঙ্গে এক সময়ে অপারেশনে নামতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী আটটি স্থায়ী ও অস্থায়ী ক্যান্টনমেন্টে বিন্যস্ত ছিল-- ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর।অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা সম্পর্কে খাদিম হুসাইন রাজা তার ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ বইয়ে লিখেছেন।

তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা। এক একটি গণহত্যার বিবরণ শুনলে দেখা যায় কি ভয়াবহ সব গণহত্যা তারা করেছে।


বিজ্ঞাপন


মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার কথা বলতে গেলেই উঠে আসে খুলনার চুকনগর গণহত্যার কথা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বল্প সময়ে একক স্থানে সবচেয়ে বড় গণহত্যা ছিল এটি। চুকনগর ছিল খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম।বহু পথ পার হয়ে গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর থেকে অজুত মানুষ ভিড় জমিয়েছিল খুলনার ডুমুরিয়া থানার চুকনগরে। এলাকার স্বাধীনতাকামী লোকজন (যারা পথ-ঘাট চিনতো) একসঙ্গে অনেক লোক জড়ো হলে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিত সবাইকে। মিলিটারি, রাজাকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় তখন অজুত মানুষ। চুকনগর বাজার মাঠ, নদীতে নৌকা ভরা শুধু মানুষ আর মানুষ। কয়েক দিন ধরে তারা জমা হচ্ছিল। জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল সবার। একথা স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে খবর চলে যায় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর কাছে। এ খবর পাওয়ার পর পাক বর্বর বাহিনীর ৪টি কনভয় চলে আসে চুকনগর বাজারে। হঠাৎ শুরু হয় গুলি। নির্বিচারে মেশিনগানের তপ্ত বুলেট ছোড়ার শব্দে পাথর হয়ে যায় এলাকাবাসী। মুহূর্তের মধ্যে কোলাহল মুখরিত চুকনগরে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। জীবিত মানুষ নেই। একদিনে সংগঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যা চুকনগর গণহত্যা। দশ হাজার মানুষকে এখানে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে সারাদেশে চলেছে গণহত্যা। ঢাকার নৃশংসতাও ছিল ভয়ংকর। রায়ের বাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজার, শিয়ালবাড়ি ছিলো জলাভুমিপূর্ণ এলাকা। আশপাশে বসতি ছিল না। ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে বুদ্ধিজীবীদেও আনাহতো, মিরপুর কমার্স কলেজও ছিল একই রকম। টর্চার সেল ছিল অনেক। তার মধ্যে মিরপুর, মোহাম্পুর, তেজগাঁও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পেছনে টর্চার সেল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর, মোহামদপুর, রায়েরবাজার, তেজগাঁও যেন জলজ্যান্ত এক কসাইখানা ছিল।

মিরপুর, মোহাম্মদপুরে পাকিস্তান বর্বর বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার,আলবদর,আলশামসের সঙ্গে বিহারী ও অবাঙালিরা গড়ে তুলেছিল অসংখ্য টর্চার সেল। ছিল অজস্র বধ্যভূমি। রায়েরবাজার, মিরপুর, শিয়ালবাড়ি এলাকায় গণহত্যার বেশ স্বাক্ষর মিলেছে মুক্তিযুদ্ধের পরে। বুদ্ধিজীবী হত্যা এসব এলাকায় করেছে। অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পাওয়া গেলেও অনেকের হদিস পাওিয়া যায়নি। মিরপুরের জল্লাদখানা ছিলো ভয়ংকর এক এলাকা। শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমির ভয়াবহতা কল্পনা করা যায় না। জঙ্গলাপূর্ণ এই এলাকার হাজার হাজার মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান মিরপুরের কুখ্যাত শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন, কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্ত কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে ২ টুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়। তাকে কিমা করার মধ্যে কোন পাশবিকতার উল্লাস?

বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জনপদকে ঘাতকরা তৈরি করেছিল এক একটি বধ্যভূমিতে-গণহত্যার চূড়ান্ত রূপ ছিল এটি। ভিয়েতনামের মাইলাই বা কাম্পুচিয়ার গণত্যার চেয়ে বাংলাদেশের কোনো জায়গায় গণহত্যা ছোট ছিল না। পাকিস্তান আজও এই বর্বরতার জন্য ক্ষমা চায়নি। বরং সেদেশের তৎকালীন জেনারেলরা তাদের বইয়ে সাফাই গেয়েছে। গণহত্যার নায়ক রাও ফরমান আলী, সিদ্দিক সালিক, খাদেম হোসাইন রাজা- সবাই। অথচ দেশে এখনও পাকিস্তানপন্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে বিভিন্ন ছত্রছায়ায়। তারা সচেতনভাবে বাড়ছে। আমরা অচেতনভাবে দেখছি। এখনও সময় আছে ফিরে দাঁড়ানোর।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর