শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

চা-শ্রমিকদের মজুরির ন্যায্যতা ও সামাজিক নিরাপত্তা

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
প্রকাশিত: ১৮ নভেম্বর ২০২২, ০৩:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

চা-শ্রমিকদের মজুরির ন্যায্যতা ও সামাজিক নিরাপত্তা

চা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ও হালকা পানীয়। বাংলাদেশে পানীয় হিসেবে চা অতি জনপ্রিয়। চা দেশের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল এবং অন্যতম রফতানি পণ্য। একটি শিল্পের প্রসারে স্থানীয়করণের প্রভাব অনন্য। একটি শিল্প ভৌগোলিক অবস্থা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শ্রমিকের প্রাচুর্য্যতা ও অন্যান্য উপাদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। চা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন অধিক বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ পাহাড়ি ঢালু এলাকা। তাই বাংলাদেশের উত্তর, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে চা বাগানগুলো গড়ে উঠেছে। চা একটি প্রাকৃতি নির্ভর ও শ্রমঘন শিল্প। চা শিল্পের বিস্তার লাভ করছে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

ভারতীয় উপমহাদেশে চা উৎপাদন শুরু হয় ব্রিটিশ শাসন আমলে। ১৭৮০ সালে চীন ও ব্রিটেনের মধ্যে বাণিজ্যিক স্বার্থের অবনতি ঘটে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের কৌশল হিসেবে চা চাষের প্রবর্তন করে এ উপমহাদেশে। ১৭৭৮ সালে কোম্পানির স্যার জোসেফ ব্যাংকস কর্তৃক পেশকৃত প্রতিবেদনে নতুন ফসলের চাষ হিসেবে চায়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।


বিজ্ঞাপন


প্রতিবেদনে ভৌগোলিক কারণে পূর্ব ভারতে চায়ের উৎপাদন সম্ভব মর্মে উল্লেখ করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় ১৮২৩ সালে আসামে এবং পরবর্তীতে আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রথম চাষের উৎপত্তি ১৮২৮ সালে। এ বছর সরকার চা আবাদের জন্য কর্তফুলী নদীর তীরে কোদলা চা বাগানের জন্য জমি বন্দোবস্ত প্রদান করে। যা সফলতা লাভ করেনি।

১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরে চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। জনশ্রুতি আছে বাগানটি ‘কুন্ডদের বাগান’ নামে পরিচিত ছিল। অ-লাভজনক হওয়ায় পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই বাগানটিও বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে সফলভাবে বাণিজ্যিক চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়ায়।

Workers

রফতানিজাত পণ্য হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে চা শিল্পের অবদান অনন্য। শিল্প হচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত পণ্য বা বস্তুর রূপগত পরিবর্তন সাধন এবং ভোক্তার জন্য উপযোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া। যার সমন্বিত রূপ হলো উৎপাদন। উৎপাদনের উপাদান ৪টি। যথা: ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন। শ্রমশক্তি বা শ্রমিক চা উৎপাদনের অন্যতম উপাদন। শ্রমিকরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ও কনকনে শীত উপেক্ষা করে চা উপাদন করে। দেশের সমৃদ্ধ চা শিল্প শ্রমিকদেরই নিরলস প্রচেষ্টার ফসল। কিন্তু একজন শ্রমিক হিসেবে তারা মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। স্বল্প মজুরিতে চা শ্রমিকেরা পরিবারের খাদ্য, পুষ্টি, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চকিৎসার চাহিদা মিটাতে হিমশিম খাচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে দেশে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। এসব বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন ও অনিবন্ধিত শ্রমিক (প্রায়) সাড়ে ৩৬ হাজার। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান ৪.৭২ লাখ (প্রায়)। চা শ্রমিকরা মাত্র ১২০ টাকায় কাজ করে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, বিবিধ হয়রানী ও নির্যাতনের অভিযোগ শোনা যায়। যেমন : গর্ভকালীন চাকুরী হতে ছাঁটাই, বেতন-ভাতা বন্ধ ও বিবিধ কারণে ছাঁটাই প্রভৃতি। বৈশ্বিক মহামারি, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও দ্রব্যমূল্যের ক্রম ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষাপটে স্বল্প মজুরিতে একজন শ্রমিকের জীবনধারণ কষ্টকর। এ কারণে চা শ্রমিকরা গত আগস্ট মাসে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে একযোগে আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে চা শ্রমিক পঞ্চায়েত ও চা শ্রমিক ফেডারেশন। শ্রমিকদের দাবি দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় উন্নীত করা। দাবি আদায়ের অংশ হিসেবে কর্মবিরতি, মিটিং, মিছিল, অবরোধসহ বিবিধ প্রতিবাদের মাধ্যমে চা শ্রমিকগণ মজুরি বঞ্চনার কথা দেশবাসীর নজরে আনে। চা শ্রমিক আন্দোলন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি চা শ্রমিক নেতা ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের সাথে বৈঠক করেন। ভিডিও কনফারেন্স করেন। প্রধানমন্ত্রীর হস্থক্ষেপে চা শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয় এবং তারা কর্মে ফিরে আসে।

দেশের চা শ্রমিকের প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী। যারা মূলত বিভিন্ন জাতি-উপজাতি ও বর্ণের মিশ্রণ। যেমন কৈরি, চাষা, তর, পরী, বুনার্ঝি, মাহাবা, কুর্মি, কাণতি, দেশওয়ারা, রবিদাশ, হাজাম, নুনিয়া, মুন্ডা, ছত্রী,ভূমিজ, রাজগর, রাজভর, খরিয়া, নায়েক, পায়েক, মাহালী, মাদব, চৌহান, প্রধান, বেনবংশী, কর্মকার, সূত্রধর, মহপ্তি, মাঝি, হাজরা, শবর, মাহির ইত্যাদি। দেশের এসব অনগ্রসর সম্প্রদায়ের নিরলস প্রচেষ্টায় চা শিল্পের বর্তমান অবস্থান। যারা দেশের একটি শিল্পকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে তাদের ন্যূনতম জীবনমান ধারণের ক্ষেত্রে সকল পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।

‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ প্রণীত হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য শ্রমিকদের নিয়োগ, মালিক-শ্রমিকসম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরি হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বিবিধ শ্রম কল্যাণ সাধন। এ আইনের ১(৬০,৬১) ধারা মোতাবেক চা বাগান একটি ‘শিল্প’ ও ‘শিল্প প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে বিবেচিত। আইনের ২(৬৫) ধারা মোতাবেক চা বাগানে কর্মরতগণ ‘শ্রমিক’ হিসেবে বিবেচিত। একটি শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক হিসেবে ন্যায্য মজুরি চা শ্রমিকের অধিকার। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩৮ ধারা মোতাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিম্নতম মজুরি বোর্ড প্রতিষ্ঠা করিবে। উক্ত আইনের ১৪০ (উপধারা-১) মোতাবেক মজুরি বোর্ড কর্তৃক বিভিন্ন শ্রমিকের জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করিবে। শিল্পের আর্থিক অবস্থা, শ্রমিকদের জীবন যাপন ব্যয়,জীবন যাপন মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, কাজের ধরণ, ঝুঁকি, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, আর্থ-সামাজিক অবস্থাসহ বিবিধ বিষয় বিবেচনা পূর্বক মজুরি বোর্ড নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করিবে। পরিতাপের বিষয় চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি হার অজও অনির্ধারিত।

Workers

চা শিল্পের সার্বিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে চা বোর্ড গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি ১৯৫৭ সালের ৪ জুন চা বের্ডে প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। তার দায়িত্বকালীন চা চাষাবাদ, চা গবেষণা, চা কারখানার উন্নয়ন ও শ্রমকল্যাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন চা বাগানের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন ও পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যনেজম্যান্ট কমিটি। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমকল্যাণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন।

সমাজসেবা অধিদফতর সমাজের অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। এ দফতরের অন্যতম লক্ষ্য সামাজিক কল্যাণ, সুরক্ষা, ক্ষমতায়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সামাজিক সাম্য সুপ্রতিষ্ঠিত করা। চা দেশের একটি অন্যতম শিল্প। এ শিল্পের শ্রমিকেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। এ প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় চা বাগান শ্রমিকদের কল্যাণের লক্ষ্যে ২০১৩-২০১৪ সালে ‘চা শ্রমিক জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। এ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য চা শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে নির্বাচিত চা শ্রমিকদের মাঝে এককালীন পাঁচ টাকা অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়। দেশের ৭টি জেলার ৩৬২টি চা বাগানে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ কর্মসূচির আওতায় ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ৬০ হাজার চা শ্রমিকের মাঝে ৩০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। তাছাড়া সমাজসেবা অধিদফতর চা শ্রমিকদের আবাসন সংকট নিরসনের জন্য গৃহ নির্মাণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করছে।

দেশের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক আনুকূল্যতায় চা শিল্প গড়ে উঠেছে। চা বের্ডের তথ্য মতে ২০২১ সালে ৯.৬৫ কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যা বাজার মূল্যে ৩ হাজার ২৫ কোটি টাকা। চায়ের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা, রফতানি বাজার সম্প্রসারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি ও চা শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ‘উন্নয়নের পথনকশা: বাংলাদেশ চা শিল্প’ শীর্ষক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। যে শিল্পের বিকাশ দেশের উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হাত ধরে। তারা এ শিল্পের প্রাণশক্তি, যার ৭৫ শতাংশই নারী। চা শ্রমিক অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং মজুরি বঞ্চনার শিকার। চা শ্রমিকদের ন্যয্য মজুরি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। চা বাগান শ্রমিকের নিম্নতম মজুরির হার নির্ধারণ করা হোক।

লেখক: সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর