বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সমাবেশের বার্তা পরিষ্কার, ধর্মঘটের বার্তা কী?

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

সমাবেশের বার্তা পরিষ্কার, ধর্মঘটের বার্তা কী?

কী একটা পরিস্থিতি! এখানে-ওখানে ডাকা হচ্ছে পরিবহন ধর্মঘট। একদল বিভাগীয় সমাবেশ ডাকে আর সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ধর্মঘট হয়ে যায়। সুকুমার রায়ের ভাষায়—‘ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ে গাত্রে হলো ব্যথা’। ছায়াকে সে ধরতে পারে না, কিন্তু ক্লান্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হতে থাকে ক্রমাগত। আমাদের রাজনীতিতেও তা চলছে? প্রশ্নটি ক্ষুদ্র, তবে এর মাজেজা অস্ফুট।

একপক্ষ সমাবেশ ডাকে তো, অন্য পক্ষের অদৃশ্য ইঙ্গিতে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়। এ নিয়ে চলছে সরব বিতর্ক, আবার কোথাও নীরব আলোচনা-সমালোচনা। ওরা আগে করেছে তখন দোষ হয়নি, তাহলে আমরা করলে দোষ হবে কেন? কে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবে তার কৌশল চলছে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। তবে ‘কৌশল-প্রতিযোগিতা’ যাই হোক আর যেই করুক শেষ পর্যন্ত ঘাড়টা জনগণের এবং বোঝাটা বহন করতে হবে তাদেরই। সে বোঝা দুর্ভোগের; ভাড়া বৃদ্ধির, দ্রব্যমূল্যের অথবা পুলিশি হয়রানিসহ আরও অনেক কিছুর। সাধারণ মানুষকে ঠিকই পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। গণপরিবহন বন্ধ থাকার কারণে পথে বের হওয়া আমজনতাকে পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

অতীতে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিয়মিত সাধারণ ধর্মঘট দেখা গেছে। অবশ্যই সেগুলো নিন্দনীয়। তার খেসারত তাকে দিতে হচ্ছে। কিন্তু সেটিকে জিইয়ে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর প্রকাশ্য বিক্ষোভ দমন করেছে, কতোটা সুস্থির তা। নব্য আওয়ামী লীগাররা সেগুলোকে নতুন করে সাজিয়ে চলমান ঘটনাকে সমর্থন দিয়ে চলছে। প্রকারান্তরে তা মেনে নিয়ে চলমান ধর্মঘটগুলো সরকার করাচ্ছে বলে প্রচ্ছন্ন মত দিচ্ছে।     

দুই.

একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে সামনে রেখে দুই দিন রংপুর বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওই বিভাগের পরিবহন। ধর্মঘট হবে, বাস বন্ধ থাকবে এবং ময়মনসিংহ, খুলনার ধারাবাহিকতায় রংপুরের পর বরিশালেও ধর্মঘট হবে।

আরও পড়ুন: সাত চ্যালেঞ্জের বাধা পেরিয়ে আওয়ামী লীগ কি পারবে?


বিজ্ঞাপন


ধর্মঘট আহ্বানকারীদের দাবিগুলো দেখলে বোঝা যায়, এ হলো স্থায়ী দাবিতে অস্থায়ী কর্মসূচি। তারা বলেছে, মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যান ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল বন্ধ করতে হবে। এদের কারণে দুর্ঘটনা হয়, বাসমালিকরা যাত্রী পান না। ফলে এসব বন্ধ করতে হবে।

প্রশ্ন হলো, একই দাবিতে ধর্মঘটের আহ্বান একটি বিশেষ দলের কর্মসূচির সময়েই কেন বারবার ডাকা হচ্ছে, সারা বছর কেন ডাকা হয় না? তাহলে কি সমাবেশ ও ধর্মঘটের মধ্যে যোগসূত্র আছে? ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সব সময়ই জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে এ ধর্মঘটের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। ব্যাপারটা, ঐক্যের, কিন্তু সম্পর্ক নেই। সম্পর্কহীন ঐক্য!  

রংপুরের ধর্মঘট আহ্বানের কারণ এবং পদ্ধতি জানা না গেলেও বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বাস মালিক সমিতির নেতারা তাদের ভয়াবহ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। যদি প্রশাসন তাদের দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিলে তাহলে ৪-৫ নভেম্বর বরিশালের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও অভ্যন্তরীণ বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ সব রুটের বাস চলাচল বন্ধ রাখা হবে।

প্রশ্ন হতে পারে—এই দাবিতে আগে তারা কী কী কর্মসূচি পালন করেছেন, সে ক্ষেত্রে পুলিশ এবং প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল সে সম্পর্কে অবশ্য কিছু জানা যায়নি এবং আন্দোলনকারীরা নিজেরাও তা উল্লেখ করেননি। যেকোনো চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে কিছু আন্দোলন তো করতে হয়। সে রকম কোনো আন্দোলনের খবর কেউ জানেন কি না তা জানা নেই।

তিন.

সামনে নির্বাচন। এই নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে যেমন বিতর্ক ও মতভেদ আছে তেমনি দলীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতাও চলছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ময়মনসিংহে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশের আগে দেখা গেল অভ্যন্তরীণ রুটসহ ময়মনসিংহ থেকে আন্তঃজেলা রুটে বাস চলাচল করছে না। এতে সাধারণ যাত্রীরা পড়লেন ভয়ানক দুর্ভোগে। আবার খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা থেকে যাওয়া কোনো গণপরিবহন খুলনায় ঢুকতে করতে দেওয়া হয়নি। বন্ধ রাখা হয়েছিল লঞ্চ যোগাযোগও। আগের রাতে বন্ধ হয়ে যায় খুলনা শহরের প্রান্তে রূপসা নদীর খেয়া পারাপার। এরপর আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেল যে, সকাল থেকে কোনো ট্রেন আসছে না। সমাবেশ আয়োজনকারীরা অভিযোগ করেছেন, তাদের গণসমাবেশে মানুষের স্রোত ঠেকাতে এই সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এ অভিযোগ খুবই স্বাভাবিক, যৌক্তিক।

আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগের দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন কেউ

পরিবহন-সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, তাদের কিছু দাবি-দাওয়া ছিল, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের জন্য তারা সরকারকে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত যানবাহন বন্ধ করে ‘আন্দোলন’ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে দুঃখজনকভাবে তাদের এই আন্দোলন কাকতালীয়ভাবে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের সমাবেশের আগের দিন থেকে সমাবেশের পরের দিন পর্যন্ত পড়ে গেছে।

বিআরটিএ চেয়ারম্যানের বক্তব্য মজার—পরিবহনের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানেন না। চেয়ারম্যান বলেছিলেন, বাস মালিকরা কেন খুলনার বাস বন্ধ রেখেছেন, সে বিষয়ে তারা আমাদের অফিসিয়ালি কিছু জানাননি। কোনো দাবি-দাওয়াও উপস্থাপন করা হয়নি। আমরা এ ব্যাপারে জানি না।

খুলনা জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সভাপতি আওয়ামী লীগের খুলনা মহানগর নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেছিলেন, ধর্মঘটের সঙ্গে বিএনপির সমাবেশের কোনো সম্পর্ক নেই। একের পর এক ধর্মঘটের খবর আসছে, বিস্ময়ের শেষ নেই। লঞ্চ শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো, ভৈরব থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত নদের খনন, ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দেওয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছেন যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিকরা। এখন কী অবস্থা তাদের আন্দোলনের, তা জানতে কৌতূহল জেগে ওঠা অসম্ভব নয়।

চার.

রিকশাওয়ালা মমিন হন্যে হয়ে গণতন্ত্র খুঁজছে। সে ভাবতে থাকে, গণতন্ত্র আসলে কী? ব্যাপারগুলো অত্যন্ত জটিল। আম-জনতা এইসব কঠিন ব্যাপার-স্যাপার বুঝে না। সরকার ও বিরোধী দল—দুই পক্ষই গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাপর অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় টিকে থাকা একমাত্র ইস্যু বানিয়ে তুলছে। কিন্তু গণতন্ত্রের সমস্যা কি শুধুই এ দুটো বিষয়? দুটো দলই তার মতো করে স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকলে তারাই আবার প্রতিপক্ষকে  ‘প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র’ থেকে বঞ্চিত রেখে নিজের জন্য সুবিধা করে নিতে সব রকম অপকৌশল আশ্রয় নিয়ে থাকে। গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের ধারণা জমিদারতন্ত্রের মতো। এ যেন জমিদার দ্বন্ধ। সেই দ্বন্দ্ব নিরসনের ক্ষেত্রে তারা বিরোধী দলে থাকাবস্থায় নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রত্যাশী হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র তাদের কাছে নীতি-আদর্শের বিষয় নয়। কোনো রকম ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য একটি কৌশলগত হাতিয়ার মাত্র। সেখানে আলাদাভাবে কোনো দলকে দেখার কিংবা পক্ষ নেওয়ার সুযোগ কই।

পাঁচ.   

রাজনীতিকে ‘রাজনীতি’দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক দিয়ে বিরোধী দলের সমাবেশকে কষ্টকর করে তোলার এই প্রক্রিয়া কোনো সুস্থ রাজনীতির পরিচয় বহন করে না, এই উপলব্ধি আসবে কবে?

যে প্রশ্ন তোলার জন্য এই লেখার সূত্রপাত, তা হলো, সমাবেশের বার্তা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পাওয়া গেলেও পরিবহন ধর্মঘটের ঘটনা যে ঘটেই চলেছে তা দেশের মানুষকে কী বার্তা দিচ্ছে? তবে, নিশ্চিতভাবেই একটি ভয়ংকর অশুভ বার্তা দিচ্ছে।

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট ক্রমবর্ধমান এই রাজনৈতিক অসন্তোষে অবদান রাখলেও, জনবিক্ষোভের এই মাত্রা বৃদ্ধি আওয়ামী লীগের শাসন ব্যবস্থার প্রতি বর্ধিত ক্ষোভ এবং ২০২৪ সালের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন তারা কীভাবে পরিচালনা করতে পারে সে সম্পর্কে (জনমনে) ভীতিরই প্রতিফলন। সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে আসছে মাসগুলোতে ক্রমবর্ধমান সহিংসতায় সরকার সমালোচকদের ওপর নিপীড়ন আরও বাড়তে পারে, পরিস্থিতির ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতাও দেখা দিতে পারে।

নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর এই সংস্কৃতির অবসান কী হবে? কয়েক বছর আগে, একটি কলাম লিখেছিলাম, ‘বিএনপির দেখানোর পথে আওয়ামী লীগও হাঁটছে?’ সেই একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে।

আমরা একটি বিস্মৃতি জাতি। খুব সহজে পেছনের ঘটনাগুলো ভুলে যাই। আওয়ামী লীগকেও এখানে ভরসা করা যায় না। কিন্তু আমাদের একদমই ভুলে যাওয়া উচিত নয়-২০০৬  সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের লংমার্চে বিএনপিও একইভাবে নির্মূল করার চেষ্টা করেছিল। কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করতে গাড়ি, ফেরি বন্ধের নানা দৃষ্টান্ত আছে। সেই সময় ঢাকাতেই একদিনে গ্রেফতার হয়েছে আট হাজার মানুষ। ঢাকায় আসা যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছিল। মতিয়া চৌধুরীকে রাস্তায় ফেলে পুলিশ দিয়ে পেটানো, ইডেনে ছাত্রদলের নির্বিচারে ছাত্রী পেটানোর ঘটনাও ঘটেছে। ফলে এ কথা বলা যাবে না আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযাত্রা নতুন, বিএনপির কাছ থেকে চলে এসেছে। সেই খারাপ উদাহরণগুলোই কি বর্তমানে চর্চা হতে থাকবে? বিএনপি যে পথ দেখিয়েছে, তাদের দেখানোর পথেই আওয়ামী লীগও হাঁটছে। আলাদা কিছু নয়। তবে এ হাঁটায় আরও বেশি হুঙ্কার। ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শর্ত পূরণ করা যাবে না কিছুতেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর