বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

জীবনের অদেখা গল্প

রাহাত আজিজ
প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৪:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

জীবনের অদেখা গল্প

‘আমি সব সময় দোয়া করি আমার ছেলেটা যেন আমার সাথেই মরে যায়। অথবা আমার আগেই যেন সে মরে যায়।’ প্রথমবার যেদিন একজন মায়ের মুখে তার সন্তানের জন্য এমন প্রার্থনার কথা শুনলাম ঠিক সেই ক্ষণে নিজের কানের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলাম না। তার দিকে শুধু তাকিয়ে রইলাম অপলক। সে আবারও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরেই বললো, হ্যাঁ, আমি এই দোয়াটা এখন সবসময় করতে থাকি। এই একটাই দোয়া আমার।

আমি সান্ত্বনা দেব নাকি রাগ করবো? আমার ছয় বছর বয়সী ছেলেটার জন্য সে এই দোয়াটা করছে! তাও একজন মা হয়ে এই দোয়া!  আমি বাবা। একজন বাবা হয়ে নিজ কানে শুনছি সেই প্রার্থনা! প্রার্থনা? নাকি অভিশাপ? আমার কানে তো বাজে অভিশাপের মতোই। মায়ের দোয়া তো বিফলে যায় না। সে কেমনে এই দোয়া করে? ওরে থামাই। ওরে থামতে বলি। সান্ত্বনা দিই, বোঝাতে চেষ্টা করি আমাদের চাইতেও আরও কত কত খারাপ অবস্থাতে আছেন আরও কতজন। আরও কত কত ডিজেবল বাচ্চারা আছে, যারা বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারে না। তাদের বাবা-মাও তো চলছে। আমার কোনো সান্ত্বনাই পারে না তারে শান্ত করতে। তার এই আশীর্বাদ/অভিশাপ এভাবেই চলে প্রায় প্রতিদিন।


বিজ্ঞাপন


কোথাও বেড়াতে যাবো কিংবা কোনো দাওয়াতে যাওয়ার কথা হলেই প্রথমে ভাবতে হয় আমাদের ছোট ছেলেটারে কার কাছে রাখবো। নাকি ওরে সাথে নেব? সাথে নিলে সামলাবো কেমনে? ওতো অনেক বেশি হাইপার থাকে সবসময়। ওর পেছনে আধা ঘণ্টা লেগে থাকলেই ঘামতে থাকি আমি। আর সহজ সমাধান তখন একটাই, মোবাইল হাতে তুলে দেওয়া। Youtube এর কার্টুনের জগতে ডুবিয়ে দেওয়া তারে। সে তখন সবার মাঝে থেকেও এক অন্য জগতের বাসিন্দা। তার পৃথিবীর পুরাটাই যেন এই কার্টুনময়। যা কিছু টুকটাক কথা বলে তার অধিকাংশই এই কার্টুনের। সে আপন মনে হাসে, কথা বলে, দৌড়ায় কখনও বা, সবই যেন অন্য এক অদৃশ্য কারও সাথে, এক কার্টুন জগতে, অদৃশ্য ইশারায়। খুব কাছের লোকজনের বাড়িতে বাধ্য হয়ে যেতেই তো হয়। অরুদ্ধ সেখানে গেলেও অস্থির হয়ে থাকে। আর আমরা থাকি আতঙ্ক, কখন কী ঘটায় বাচ্চাটা। কখন সে খেলনা ভাঙে বা কখন কোনো খাবার ছুড়ে ফেলে, কখন সবার আসরের মাঝে ব্যঘাত ঘটায় আমার বেমানান বাচ্চাটা- আমরা কুণ্ঠিত হয়েই রই। কাছের লোকে কিছু বলে না, সান্ত্বনা দেয়, সহমর্মিতা দেখায়। তাদের চোখে থাকে করুণা। আমার সেই করুণার দৃষ্টিও সহ্য হয় না। আমরা কোনো করুণা চাই না। তবু অনেক চোখেই থাকে করুণা। আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি, অন্তত ঘৃণা বা বিরক্তি নেই তাদের চোখে- শুধু এই একটা কারণেই।

বাচ্চাটারে নিয়ে যখন কোনো রেস্টুরেন্টে যাই তখন কিছুক্ষণের মধ্যেই সাড়া পড়ে যায়। সবগুলো টেবিলের লোকে দেখে একটা অদ্ভুত বাচ্চা এসেছে। কারণ, আমার ছেলে অনেক সময় আপন মনেই হুমমম, হুমমমম টাইপ আওয়াজ করতে থাকে এবং এই অদ্ভুত আওয়াজেই অনেকের চোখ আমাদের টেবিলে আটকায়। কেউবা একটু ভ্রু কুঁচকে নেন এমন বেমানান আওয়াজে। আবার কখনও সে ছুটে যায় এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে, যে কারও প্লেটেও ঝাপটা দেয় তারে আমরা ধরে ফেলার আগেই। স্যরি, স্যরি, ভাই দুঃখিত- সবার কাছেই এই দুঃখ প্রকাশ করে মার্জনা চাইতে হয়। আসলেই আমরা স্যরি, আমরা স্যরি এই সুন্দর পৃথিবীর সবার কাছে, কারণ আমাদের একটি বেমানান প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। আমরা তাই স্যরি সবার কাছেই।

আমার ছেলেটার নাম অরুদ্ধ এবং তার বড় ভাই অরিত্র। অরিত্র এখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ছে। অরুদ্ধের বয়সে অরিত্রের পটপট কথা আর দুষ্টুমিতে মুখরিত ছিল আমাদের চারপাশ। হয়তো সেই মধুর সময়ের লোভেই আমরা আবার নিয়ে আসি অরুদ্ধকে। আর অরুদ্ধ সেই ঝকঝকে শৈশবের ছোঁয়া না পেয়ে বন্দী হয়ে আছে এক অন্য জগতে। আমার ছেলেকে কখনও কোথাও কেউ রুদ্ধ রাখতে পারবে না এমনটা ভেবেই তার নাম রাখি অরুদ্ধ। এমনকি বাংলা একাডেমির অভিধানে এই শব্দটি ছিল না। তাতে আমার কী? আমার অরুদ্ধ তো অরুদ্ধই হবে। অভিধানে তার নামের অর্থ না থাকলেই কী! আমিই গড়বো আমার অরুদ্ধ- এই ভেবেই তো এই নাম রাখা। কিন্তু এখন তো আমার অরুদ্ধ হাইপার একটিভ বাচ্চা, অটিজম, ADHD,ASD আরও কত সব জটিলতা নিয়েই চলছে এবং তারে সামলে রাখাও কঠিন। এখন আসলেই সে অরুদ্ধ।

মাঝে মাঝে আমার মা বলেন অরুদ্ধ নামটা পাল্টে ফেলতে। 'নামের তাসির' মানে নামের প্রভাব নাকি বর্তায় মানুষের চরিত্রে। তাই, অরুদ্ধের দাদি ভাবছেন এই অরুদ্ধ নামটা বদলে দিলে যদি কিছুটা শান্ত করা যায় তারে। আচ্ছা, কী নাম রাখবো তার? নতুন নাম কী হবে? এমন বাচ্চাদের তো নাম একটাই হয়- প্রতিবন্ধী। আমার ছেলেটাও তো সেই একই নামের ভেতরেই আটকে আছে। আগে কখনও এই শব্দটা যে এতটা কষ্টের বুঝিনি কিন্তু যখন নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে গেল এই শব্দটি তখন থেকে জানি এই একটা শব্দই যেন পৃথিবীতে এসেছে সরাসরি দোজখ থেকে। দোজখের সব আগুন নিয়ে। বুকের ভেতর তোলপাড় হয় এই শব্দটি শুনলেই। মনে হয় পুরো একটা পৃথিবী থাকলে তাও দিয়ে দিতে পারি শুধু এই শব্দটি মুছে ফেলতে, এই আগুন নেভাতে।


বিজ্ঞাপন


এবার অন্য একটা দিনের গল্প শোনাই। এক রাতে দেখি আমার থ্রিতে পড়া ছেলে মায়ের পাশে শুয়ে চোখ মুছছে। ওর দুই চোখই লাল। ওর মা নিশ্চুপ। অরুদ্ধ মাটিতে বসেই খেলছে আপনমনে। কেন কাঁদছে ছেলেটা, জানতে চাই। অরিত্র মুখ লুকোয়। ইশিতা জানালো- অরিত্রের মাথায় হঠাৎ এসেছে ওরা বড় হলে তো বাবা-মা মারা যাবে। তখন অরুদ্ধের কী হবে? অরুদ্ধ তখন কী করবে? ইশিতা বুঝিয়েছিল যে, তখন অরিত্র দেখে রাখবে তার ভাইটারে। ইশিতা আরও বলেছিল যে, বাবা, তোমার বৌ তো বিরক্ত হতে পারে তোমার ভাইরে তোমার পাশে রাখলে। তখন কী করবা? সেই ভাবনা থেকেই অরিত্রের ছোট্ট দুনিয়াতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সে এর সমাধান করতে পারছে না। যদিও অনেক সমাধান দিয়েছে, যেমন সে কখনও বিয়েই করবে না অথবা তার বৌ বিরক্ত হলে অরুদ্ধরে আলাদা বাসাতে রাখবে। কিন্তু তার এসব সমাধানের কোনোটাই ইশিতার কাছে যৌক্তিক লাগেনি। সেই থেকেই কান্না শুরু অরিত্রের। ইশিতার ও গলা ধরে গেছে সেই সব কথা বলতে গিয়ে আমারে। সেও সেই একই প্রশ্ন আবারো জিজ্ঞেস করে আমারে। অরুদ্ধের কী হবে, আমরা যখন থাকবো না? আমি এর উত্তর জানি না। আমি ভাবতেও চাই না। আমি কোনো উত্তর দিই না এই প্রশ্নের। তাও মাঝেমাঝে বলি, যিনি পাঠাইছেন তিনিই ওরে দেখে রাখবেন। ভবিষ্যৎ এতো দেখার দরকার নাই তোমার-আমার। সবার উপরে একজন তো আছেনই, তিনিই দেখে রাখবেন। তিনিই ভালোবাসবেন, তিনিই আমাদের ভালোবাসেন সবাইকে, সবচেয়ে বেশি। কখনও বলি- আল্লাহ মানুষরে ততটাই বোঝা দেন যতটা সে বইতে পারবে, সইতে পারবে। তিনি আমাদের দিয়েছেন এই জেনেই যে, আমরা বইতে পারবো।

আমার এসব কথাতে তেমন লাভ হয় না। পাল্টা প্রশ্ন আসে, একটা প্রশ্নই- উপরওয়ালার এত ভালোবাসা কেন? তিনি এত ভালোবেসে কেন আমার বাচ্চাটারে অটিস্টিক বাচ্চা করে পাঠালেন? এইটা কেমন ভালোবাসা? এই ভালোবাসার কী দরকার? এত ভালোবাসার কোনো দরকার তো ছিল না। আমি পারছি না, আমি পারবো না। আমার চোখের সামনে যখন দেখি ওর বয়সি বাচ্চারা কলকল করছে, খেলছে, হাসছে, আমার আর সহ্য হয় না। এই বোঝা আমি বইতে পারছি না সেইটা কি আল্লাহ দেখেন না। এসব বলতে বলতে প্রায়ই রাগে-দুঃখে ইশিতার গলা কাঁপে, চোখ ছলছলায়। আমি সান্ত্বনা নিজে খুঁজে নিছি, নিজের জন্য। সেই সান্ত্বনাটুকুই ইশিতারেও দিয়ে যাই। কাজ তেমন হয় না। তবু, কিছু তো বলতে হয়, তার পাশে দাঁড়াতে হয় টলমল শরীর নিয়ে। তখন আমার শেষ সান্ত্বনার বাণীটুকু শোনাই এভাবেই-শোনো, এই বাচ্চাটাই আমাদের বেহেশতের ভিসা। শেষ বিচার শেষে আমার এই ছেলেটারে তো নিশ্চিত বিনা বিচারেই বেহেশতে পাঠাবেন খোদা। ফেরেশতারা যদি একটা-দুইটা দোষও লিখে থাকেন তখন আল্লাহই হয়তো বলবেন - ও ফেরেশতা, আমার এই বান্দাগুলোরে আটকায়ো না। এরা তো দুনিয়ার সুখ-দুঃখ কিছুই এক মুহূর্তের জন্য টের পায়নি। এদের আজ আর কোনো বিচার নেই। এদের আমার জান্নাতে এখুনি পাঠিয়ে দাও। তখন কী হবে জানো বৌ? তখন যদি আমি বা তুমি বেহেশতের পার্মিশন নাও পাই দেখবা আমাদের এই বাচ্চাটাই তখন বলবে- ও আল্লাহ, আমি তো দুনিয়াতে থাকতে বাবা-মা কী, তাদের ভালোবাসা কী, তাদের সাথে কেমন করে হেসেখেলে দিন কাটে সেইসবের কিছুই চিনলাম না, জানলাম না। এখন যদি আমার বাবা/মায়েরে আমার থেকে আলাদা করে দাও তাইলে এই জান্নাতে গিয়ে আমি কী করবো। ইয়া মাবুদ, হয় এদেরকে আমার সাথে দাও জান্নাতে থাকতে নাইলে আমারেও জাহান্নামেই দাও আমার বাবা/মায়ের সাথে।

বৌ একটু ভাবো। এমন কথা যদি পরওয়ারদিগার শুনেন তখন তিনি কী করবেন? তিনি কি এই বাচ্চাটার কথা ফেলতে পারবেন? এত বড় অবিচার কি ন্যায় বিচারক যিনি তিনি করতে পারবেন? তাই, তোমার-আমার জান্নাত তো এই ছেলের হাত ধরেই নিশ্চিত। এই দুনিয়ায় না হোক, পরের জগতে তো আমাদের অরুদ্ধ ঠিকঠাকই থাকবে।

আমার পরের জগতে না, এই জগতেই চাই। আমার জান্নাতের দরকার নেই, আমার দরকার এই জগতেই আমার সুস্থ একটা বাচ্চা। সুস্থ অরুদ্ধ চাই আমি এই জগতে। ইশিতা খেকিয়ে ওঠে, কাঁপতে থাকে তার কণ্ঠ, চোখের পাতা। তবে, চোখের জল এই ক'বছরে অনেকটাই শুকিয়ে গেছে ওর। ইশিতা আর কোনো সান্ত্বনাতেই ভুলে না, ভুলবেও না।

আমারও জান্নাতের লোভ আসলে তেমন নাই। কিন্তু নিজেরে তো বোঝাতে হয়। নিজেরে একটা প্রলোভনে ডুবিয়ে রাখতেই এই জান্নাতে অরুদ্ধরে নিয়ে সুখি ঝলমল দিনের স্বপ্ন দেখি। সুস্থ অরুদ্ধরে পাইলে জান্নাতের মায়াটা আমিও ছাড়তে রাজি।

একটা কথা, একটা প্রশ্ন, ইদানীং প্রায়ই আমার মনে ঘুরতে থাকে। আমাদের মহানবী নাকি কোনো এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন- এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝা হলো পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, আমি যে ঝলমলে পরিবারের হঠাৎ নিথর হওয়া শবদেহ টেনে নিচ্ছি দিনের পর দিন সেই বোঝাটারে কী বলবেন প্রিয়নবী? এর চেয়েও কি ভারী কোনো বোঝা হতে পারে? আমার ছেলেটার জীবিত থেকেও মৃত পথচলা আর প্রতিদিন নিজ সন্তানের মৃত্যু কামনা দেখার বোঝাটারে কতটা ভারী হতে তা কি বলবেন আমারে প্রিয় পয়গাম্বর?

লেখক: কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার, এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড, মৌলভীবাজার শাখা, মৌলভীবাজার

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর