শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্ষণ ও দেহব্যবসা: রাষ্ট্রের দায় কী?

রফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্ষণ ও দেহব্যবসা: রাষ্ট্রের দায় কী?

বিশ্ব যে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে দ্রুতগতিতে বহুদূর এগিয়ে গেছে, আমরা সে সময় রাজনীতির বলির পাঠা বানিয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রতিভাকে শেষ করে দিচ্ছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ আজ ধ্বংসের পথে। এ দায় কি রাষ্ট্র এড়াতে পারে?

সম্প্রতি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি ইডেন মহিলা কলেজে যে ঘটনার অভিযোগগুলো গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, তা নিশ্চয়ই সকল পিতামাতার হৃদয়কেই আহত করেছে। আমার বিশ্বাস, সকল অভিভাবকই চান- তাদের সন্তান সুন্দর একটি পরিবেশে শিক্ষা অর্জন করুক, নীতি-নৈতিকতা শিখুক, পড়াশোনা শেষে চাকরি করে সংসারের অর্থনৈতিক সংকট দূর করুক এবং আদর্শবান মানুষ হয়ে বা সম্মান নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকুক।


বিজ্ঞাপন


কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবে কে? অবশ্যই সরকার। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর আদায় করে জনগণের মাঝেই সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার-খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করবে সরকার।

দুঃখের বিষয় হলো- এসব অধিকার নিশ্চিত করা থেকেও আমাদের সরকারকে বেশি তৎপর দেখা যায় ভিন্ন মত-দলকে দমন করার প্রতি। যেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতেও দেখা যায়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হচ্ছে না।

যাইহোক, ইডেন কলেজে যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা নতুন নয়। ২০১৭ সালে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে কর্মরত থাকাকালে ইডেন কলেজ নিয়ে আমি কিছু অভিযোগ পাই। খোঁজখবর নিতে গিয়ে তখন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজ ও হোম ইকোনমিক্স কলেজেও প্রায় একই অভিযোগ পাই। যা এখন এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। অভিযোগের ভিত্তিতে তখন আমি একটা প্রতিবেদন করি। তখন বড় অভিযোগ ছিল- হলের সিটে নতুন ছাত্রী উঠলে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া (এককালীন পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা), হলে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা এবং সুন্দর সুন্দর ছাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি করা। এসব অভিযোগ স্ব-স্ব কলেজ কর্তৃপক্ষ জানে কিন্তু ভয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় না- এমনটি শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন।

পরে আমি প্রত্যেক কলেজের প্রিন্সিপাল, নেত্রীদের সঙ্গে ও তখনকার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথাও বলি। প্রতিবেদনটি প্রকাশ হলেও কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (সদ্য বহিষ্কৃত) সামিয়া আক্তার বৈশাখীর কিছু বক্তব্যের জের ধরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি ‘দেহ ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট চাই না, চাই না’- এমন প্ল্যাকার্ড নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও করতে দেখা যায়, যা গণমাধ্যমে প্রচারও হয়। এরপর কলেজটিতে পাল্টা অভিযোগ, মারামারি, কমিটি বিলুপ্তের ঘটনাও ঘটে।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো ‘চাঁদাবাজি, আসন–বাণিজ্যে ছাত্রলীগ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ‘ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, আসন–বাণিজ্য ও ছাত্রীদের দিয়ে জোর করে অনৈতিক কাজ করানোর যেসব কানাঘুষা ছিল, তা এবার প্রকাশ্যে এল ছাত্রসংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। ছাত্রলীগের বড় অংশ বলছে, তাদের নেত্রীরাই এসব অপরাধে জড়িত।’

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে একটি গুরুর অভিযোগ হলো, সাধারণ ছাত্রীদের আপত্তিকর ছবি তুলে রেখে তাঁদের অনৈতিক কাজ অথবা আসন ছাড়তে বাধ্য করা। কখনও কখনও আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকাও আদায় করা হয়।’

এছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একই তারিখে (২৭ সেপ্টেম্বর) ‘ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত, স্থায়ী বহিষ্কার ১৬: ইডেনে কোটি টাকার সিট বাণিজ্য’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়- ‘৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিদ্যাপীঠ ইডেন মহিলা কলেজ। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর আবাসনের জন্য আছে মাত্র ছয়টি ছাত্রীনিবাস। সিট আছে তিন হাজার ৩১০টি। হলে থাকছেন অন্তত ১২ হাজার শিক্ষার্থী। একেক কক্ষে ১২ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত থাকছেন। গাদাগাদি করে অনেকটা কষ্টের মধ্যেই পড়াশোনা করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এই সংকট কাজে লাগিয়ে সিট বাণিজ্য করছেন ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেত্রীরা।’

‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে একই কায়দায় সিট বাণিজ্য করেছেন ছাত্রদলের একশ্রেণির নেত্রীরা। বর্তমানে কলেজটির ছয়টি আবাসিক হলের বেশিরভাগ কক্ষই নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা। আসনসংখ্যার বাইরে ও ভেতরে সব শিক্ষার্থীর বেশিরভাগেরই ছাত্রলীগ নেত্রীদের এককালীন ও মাসিক চাঁদা দিয়ে থাকতে হয়।’

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়- ‘আসনসংখ্যার বাইরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বছরে এককালীন ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় নেত্রীদের। বৈধ সিটসংখ্যার বাইরে প্রতিজন থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নিলেও নয় হাজার শিক্ষার্থী থেকে বছরে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়। এই টাকা বাণিজ্য করতে হলের অনেক কক্ষকে পলিটিক্যাল রুম বানিয়েছেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা।’

এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা টাইমস লিজা আক্তার হোসাইন নামে ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক এক ছাত্রীর বক্তব্য প্রকাশ করে। এমন ঘটনা নতুন নয়, বলে দাবি করে লিজা তার ফেসবুকে জানান, ‘বর্তমানে কলেজটির যে চিত্র টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমের খবরে উঠে আসছে, তা বহু পুরনো। এমন দৃশ্য তাকে প্রায়ই দেখতে হতো। কলেজটির পরিবেশ জঘন্য।’

তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ইডেন থেকে বলছি। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কখনো মুখ উঁচিয়ে গল্প করার মতো কিছু বলতে পারিনি বন্ধু মহল কিংবা আত্মীয় কিংবা করপোরেটে। পরীক্ষার সময়টুকু বাদ দিলে সবমিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন ক্লাস করেছি। দুই-একজন ক্লাসমেটের সহযোগিতায় ক্লাসের আপডেট নিতাম আর পরীক্ষার সময় শুধু পরীক্ষা দিতাম।’

লিজা তার ফেসবুকে আরও লিখেন, ‘প্রাইভেটের খরচ চালানোর চাপ দিতে চাইনি বাবা-মাকে। তাই শত কষ্ট চুপচাপ মেনে নিয়ে চেষ্টা করেছি পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে। আজকে যা আপনারা টিভিতে নিউজে দেখছেন, এসব আমরা টুকটাক প্রায়ই দেখতাম। জঘন্য এক পরিবেশের ভেতর, বিশেষ করে হলের ভেতর। জোর করে মেয়েদের রাজনীতিতে নামানো এবং রাজনীতি করা এখানকার শিক্ষাদান। যেন দলভারী করার জন্য এক ফ্যাক্টরি খুলে বসছে।’

এদিকে, ২৬ সেপ্টেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে ‘ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেগুলো অপরাধীদের কাজ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে সিট-বাণিজ্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছাত্রীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে। গত আগস্টেও নির্যাতনের সময় দুই শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সভাপতি তামান্না জেসমিন রীভার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গতকাল কলেজ ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।’

একই প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, এগুলো তো অপরাধীদের কাজ। অভিযোগ সত্য হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু, সেটা তো হবে না। কারণ, এসব নেত্রীরাই সরকারের প্রহরী, সৈন্য। কিংবা আরেক দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের ব্যবহার করবে। ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাধ করা হচ্ছে। ইডেন কলেজে যেসব অন্যায় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কাজ কল্পনা করা যায়?’

যাইহোক, সম্প্রতি শিশু সুরক্ষায় কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধের দাবি জানিয়েছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। গত ২৭ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি জানায়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৪.৪৪ শতাংশ। যৌন হয়রানি ও নির্যাতন প্রসঙ্গে সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সারাদেশে এক হাজার ১১৭ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা ২০২০ সালে ছিল ৬২৬ জন।

এদিকে, প্লান ইন্টারন্যাশনালের সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়রানির শিকার প্রায় ৭৪ শতাংশ ছাত্রী। এ কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ছাত্রী। আর বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করেন ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পড়ালেখা ছাড়েন ৯ দশমিক ৬ শতাংশ ও অসুস্থ হয়ে পড়েন ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন ৯০ শতাংশের ওপরে।

গবেষণায় ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী দুই হাজার ২৩২ জন শিশু থেকে নারী ও একই বয়সের দুই হাজার ২০৮ জন শিশু থেকে তরুণ অংশ নেন। এছাড়া দুই হাজার ২১৭ জন মা এবং দুই হাজার ১৯৭ জন বাবা গবেষণাটিতে অংশ নেন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়রানির শিকার হতে পারে এই ভয়ে দেশের ৫৪ শতাংশ বাবা তার মেয়েকে কোচিং অথবা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে দিতে চান না। অন্যদিকে ৬২ শতাংশ মা তার মেয়েকে স্কুলের পিকনিকে পাঠাতে নারাজ।

ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে সহপাঠী বা সিনিয়রদের কাছ থেকে মোবাইলে আপত্তিকর মেসেজ পেয়েছেন ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করেছেন ২১ দশমিক ৩ শতাংশ সহপাঠী। এছাড়া পুরুষ শিক্ষকদের যৌন হয়রানির শিকার হন ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছাত্রী। আর শিক্ষকদের কাছ থেকে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন ৫৬ শতাংশ।

উপরন্তু বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ কতটা নাজেহাল। কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে থাকতে পারে না? যাইহোক, সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারকে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক।

ডব্লিউএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর