শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ইডেনের সাম্প্রতিক অরাজকতা প্রসঙ্গে আমার উপলব্ধি

সুমনা আফরিন ইভা
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ইডেনের সাম্প্রতিক অরাজকতা প্রসঙ্গে আমার উপলব্ধি

খবরে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের মারামারি-চুলাচুলির ভিডিও গতকাল থেকেই ভাইরাল। ইডেন মহিলা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে ফোনে নানান জিজ্ঞাসা, মেসেঞ্জারে ঠ্যাস মারা আলাপ, আশেপাশে কানাঘুঁষা দেখতে হচ্ছে। অফিস শেষে পুরনো সতীর্থদের সাথে চা-চক্রে শুনলাম তাদের অফিসের ঊর্ধ্বতন থেকে অফিস পিয়ন পর্যন্ত এই ঘটনা নিয়ে তাকে বিরূপ মন্তব্য করেছে। নিউজের কমেন্ট সেকশনে পড়ে দেখি নিজের গায়ে আর মনে দুর্গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এমন লোকও মুখে উচ্চারণ করা যায় না এমন সব ভাষায় কমেন্ট করে বসে আছে। কেউ কেউ ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ স্বামীদের আগাম আত্মার মাগফেরাত কামনা করছে!

আমি ছয় বছর ইডেনের হলে থেকেছি। প্রথম বর্ষে ইডেনের হলে কী কী অকাজ হয় সে বিষয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে প্রচুর কৌতূহল উদ্দীপক প্রশ্ন পেতাম।


বিজ্ঞাপন


আত্মীয়-পরিচিতর মধ্যে কোনো মেয়ে হয়তো মেরিট লিস্টে এসেছে, তার বাবা-মা ফোন করতো মেয়েকে ইডেনে ভর্তি করাবে কি না। ঘুরিয়ে-পেচিয়ে অভিভাবকরা বলতো- মা, ইডেনের পড়ালেখার মান ভালো। কিন্তু আমাদের ভয় মানুষজন তো ইডেনকে ভালো বলে না। এরপর আবার কাউকে তথ্য দিতে হতো হলে উঠলে মেয়ে উচ্ছন্নে যাবে কি না।

একটু পুরাতন হওয়ার পর এর-ওর মুখে শুনলাম ইডেন কলেজের মেয়েরা বেজায় ডেয়ারিং। একপর্যায়ে এসে শুনলাম, যেসব মেয়ে ইডেনে পড়ে তাদের নাকি বিয়ে-শাদি হয় না। পাত্র পাওয়া ভারী মুশকিল!

eden2

এখন কথা হলো ছয় বছরে আমি ইডেনে কী কী দেখেছি। আমি দেখেছি সহপাঠীকে বোন হতে, আমি দেখেছি সিনিয়র-জুনিয়রের মিষ্টি রসায়ন, আমি দেখেছি শিক্ষিকা-ছাত্রীর মধুর সম্পর্ক, আমি দেখেছি তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সাথে বসে মেয়েদের আড্ডা, আমি দেখেছি টিভি রুমে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার পরে মেয়েদের বিজয়োল্লাস, আমি দেখেছি পুকুরঘাটে হারমোনিয়াম-তবলা গানের আসর, আমি দেখেছি রুমমেট বা পরিচিত কারো বিপদে মেয়েদের ঝাঁপিয়ে পড়তে, নামাজ রুমে সমবেতভাবে ছাত্রীদের নামাজ আদায় করতে দেখেছি, যা ছিল ইডেনের রোজকার চিত্র। রিডিংরুমে পড়তে গিয়ে আমি দেখেছি অসংখ্য মেধাবীকে, যারা নিজেদের সাফল্যের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে দেশ ও মানুষের সেবা করছে। প্রতিষ্ঠানের জন্য বয়ে এনেছে গর্ব করার মতো উদাহরণ। ঐতিহ্যবাহী ইডেনের প্রতিটি পরতে পরতে আমার শিক্ষা জীবনের আনন্দময় সময়ের স্মৃতিচিহ্ন এঁকে এসেছি।


বিজ্ঞাপন


প্রিয় এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণার অভাব নেই। মানুষ নিজ চোখে না দেখে, নিজ কানে না শুনে মুখস্থ কথার মতো বলতে দ্বিধা করে না ইডেনের মেয়েরা ওমুক, ইডেনের মেয়েরা তমুক। যা বর্তমান এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের হৃদয় ব্যথার ভারে ন্যুব্জ করে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য মেয়েদের কত প্রচেষ্টা করতে হয়। লক্ষ মেয়ে ইডেনে ভর্তি লড়াইয়ে হেরে মুখ লুকিয়ে কাঁদে।

এবার আসি মূল কথায়। এই মেয়েরা কারা যাদের মারপিটের ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হলো। এরা একটি নির্দিষ্ট দলের নেত্রী-কর্মী-সমর্থক। ইডেনে ভর্তির পর থেকেই ক্যাম্পাসে এদের রাজত্ব দেখে এসেছি।

ছয় বছরে ক্যাম্পাসে বড় যত ঝামেলা দেখেছি সব পলিটিক্যাল। রাজনীতি মানেই যেন আমাদের দেশে ক্ষমতার চর্চা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মামলা-হামলা। দেশের উচ্চ শিক্ষা স্তরে ছাত্ররাজনীতি চর্চা নতুন নয়। ছাত্র রাজনীতি স্বীকৃত পাবলিক-প্রাইভেট সকল প্রতিষ্ঠানে নিত্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই আছে। ইডেনেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইডেনের ছয়টি হলে সিট বাণিজ্য আর ছাত্রী নির্যাতন হামেশাই ঘটছে।

যারা ইডেন সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণা রাখেন তারা অবগত আছেন, শিক্ষার্থীরা দুটি ভাগে বিভক্ত। সাধারণ ছাত্রী ও পলিটিক্যাল। ইডেন অভ্যন্তরে পলিটিক্যাল মেয়েদের সার্কেল আলাদা, ওদের রুম আলাদা, ওদের ব্লক আলাদা, ওদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আলাদা, ওদের আড্ডার অবস্থানও আলাদা। মোটকথা, ওদের জীবনযাত্রা সাধারণ মেয়েদের থেকে অনেক ভিন্ন।

ইডেনে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। পলিটিক্যাল মেয়েদের সংখ্যা হয়তো ইডেনের মোট শিক্ষার্থীর তিন থেকে চার শতাংশ। এই চার শতাংশ মেয়ের জন্য আমাদের সমাজের কিছুসংখ্যক বিচারক ৪০ হাজার মেয়েকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। নিয়ত মেয়েদের মানসিকভাবে পীড়ন করে।

আমাদের দেশের সংকীর্ণমনা গ্রুপের ক্ষেত্রবিশেষে একেক জেলা নিয়েও এলার্জিও শেষ নেই। কোনো এক জেলা হোক বা কোনো প্রতিষ্ঠান হোক শতভাগ মানুষ কখনোই সুশীল হবে না। একশ ভাগের গন্তব্যও এক হবে না।

কেউ বিরাট চাকরি করবে, কেউ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবে, কেউ বিদেশে নাম করবে, কেউ রিকশা চালাবে, কেউ দিনমজুর হবে, কেউবা পতিতাবৃত্তিতে যাবে। সবকিছু সমান্তরালভাবে চলবে না। সু-রিপু, কু-রিপু পাশাপাশি অবস্থান করবে এটাই দুনিয়ার রীতি।

eden3

বাইরে বেশি ভাড়া দিয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে অনেক ছাত্রী বাইরের তুলনায় কম টাকা দিয়ে গণরুমের কষ্ট সয়ে, নেত্রীদের নানা কীর্তি সয়ে, টিউশনি করে, কোনোমতে দু-চারটে কাপড় দিয়ে অনেক মেয়ে শিক্ষাজীবন পার করে। শুধু নিজের পরিশ্রম ও মনোবল নিয়ে বর্ণনাতীত কষ্ট করে যারা আজ সফল তাদেরকে আমাদের সমাজ, আমাদেরই পরিচিতজন, তথাকথিত শিক্ষিত-বিদ্বানরা আজ শব্দবাণে মানসিক অত্যাচার করে চলেছেন।

ইডেনের ছিটেফোঁটা দোষ খুঁজে ফেরা এলার্জিটিক লোকেরা কি খবর রেখেছে কত মেয়ের পরিবার এই পরনিন্দার দুষ্টচক্রে পড়ে পড়াশোনা ছাড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে? কেউ কি সেই মেয়ের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করেছে, যার স্বামী বিয়ের পর বউ ইডেনে পড়বে শুনে পড়ালেখার ইতি টানতে বাধ্য করেছে। খবর রেখেছে কি তারা কত মেয়ে অত্যাচারিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে?

একবার অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে অনৈতিক কাজের দায়ে আটক হলো। সেই মেয়েকে ইডেনের মেয়ে বলে একটা শ্রেণির চাপানোর জন্য সেকি চেষ্টা করলো। যার সত্যিটা সবাই পরবর্তী সময়ে জেনেছিল। আজিমপুর কলোনিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা ভাড়া থাকে। দেখতাম কলোনিতে কোনো মেয়ে আড্ডা দিলেই সে হয়ে যায় ইডেনের মেয়ে!

মানুষের মুখস্থ ধ্যান-ধারণার সাথে পাল্লা দিয়ে পারা যায় ঠিক তবে এতে মনের মধ্যে একপ্রকার বিষাদ তৈরি হয়। প্রতিনিয়ত মেয়েরা এসব মেন্টাল হ্যারাসমেন্টের শিকার হচ্ছে। যার প্রতিকার চাইতে গেলেও মন্দ কথার ফুলঝুরি। ইডেনের সন্নিকটে ঢাকা কলেজ। কিছুদিন আগেই সেখানে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। পরপর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ। কদিন পর ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘর্ষ।

তার কিছুদিন বাদে ছাত্রলীগ-ব্যবসায়ী সংঘর্ষ। রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাজধানীর মূল পয়েন্টগুলো একদম অচল করে রাখা হয়েছিল। মানুষের সেকি ভোগান্তি! তখন এসব নিয়ে কারোর তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। ছেলেদের মারামারির ইস্যু ফেসবুক ওয়াল ভরে লেখার জন্য রসালো কোনো রসদ না। মেয়ে হলেই লেখা জমে ক্ষির হয়ে যায়! মেয়েদের কলেজ হলে তো সে খবর আরও মুখরোচক!

মানুষরুপী ভণ্ডদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়তে ইচ্ছে হয়- তারা কি শুধু মেয়েদের মধ্যেই মানুষের সমস্ত গুণের সমাহার দেখতে চায়? পুরুষশাসিত সমাজে সকল দায় যেন মেয়েদের। মেয়েরা রক্ত-মাংসের মানুষ। মেয়েদের মধ্যে ও দোষত্রুটি, ভুলভ্রান্তি আছে।

থুথু মাটিতে ফেলে তা আবার চেটে নেবার মতো লোকেরাও চায় মেয়ে মানেই হবে পূতঃপবিত্র। মেয়ে মানেই হতে হবে ধোয়া তুলসীপাতা! এই শ্রেণির ভণ্ডদের প্রতি আমার রাগ কিংবা ঘৃণার চেয়েও যা বেশি হয় তা হলো অনুকম্পা।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর