‘হিজড়া’ শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে ‘গোত্র হতে পরিত্যক্ত’ অর্থে এসেছে। পরবর্তীতে তা হিন্দি ভাষায় বিদেশি শব্দ হিসেবে প্রবেশ হয়। শব্দটির ভারতীয় ব্যবহারকে প্রথাগতভাবে ইংরেজিতে ‘ইউনাক’ (খোঁজা) বা ‘হারমাফ্রোডাইট’ (উভলিঙ্গ) হিসেবে অনুবাদ করা হয়। যেখানে ‘পুং জননাঙ্গের অনুপস্থিতি হল উক্ত সংজ্ঞার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু।’
বিশ্বজুড়েই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সংগ্রামের। আমাদের সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী অন্যতম। নিজেদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক স্বীকৃতির জন্য প্রতিনিয়ত বৈষম্য ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয় লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের। রাষ্ট্রীয় ‘হিজড়া লিঙ্গ’ স্বীকৃতি, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রে স্বতন্ত্র পরিচয় প্রদানের সুযোগ তৈরির মতো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নসূচকে এই জনগোষ্ঠী এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। দেশের সর্বসাধারণের এখনও হিজড়া ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই।
বিজ্ঞাপন
হিজড়া কি বা কারা?
হিজড়া কোনো লৈঙ্গিক পরিচয় নয়, এটি মূলত একটি কালচার/সংস্কৃতি। সমাজের ধরে-বেঁধে দেওয়া নারী বা পুরুষ পরিচয়ের বাইরেও রয়েছে, রূপান্তরিত বা ট্রান্সজেন্ডার নারী-পুরুষ, জৈবিক দিক থেকে বৈচিত্র্যময় নারী-পুরুষ, ইন্টারসেক্স বা আন্তঃলিঙ্গের ব্যক্তিসহ আরও কিছু লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষ। একজন পুরুষ যখন লৈঙ্গিক অতৃপ্তি বা অস্বস্তির কারণে একজন নারীর জেন্ডার ভূমিকায় স্বস্তিবোধ করেন, তখন তার পরিচয় হয় ট্রান্সজেন্ডার নারী। একইভাবে একজন নারী যখন পুরুষের জেন্ডার ভূমিকায় স্বস্তিবোধ করেন এবং সেই মোতাবেক নিজেকে পরিবর্তন করেন, তখন তিনি হয়ে উঠেন ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ। হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা অনেকটা পরিচিত হলেও ‘ইন্টারসেক্স’ শব্দটি অনেকের কাছেই অজানা।
গর্ভাবস্থায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মের সময় কিছু শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণে সমস্যা দেখা দেয়। লিঙ্গ দেখে বোঝা যায় না যে, শিশুটি ছেলে নাকি মেয়ে। আর এই শিশুদের বলা হয় ইন্টারসেক্স বা আন্তঃলিঙ্গ। জন্মগতভাবে ইন্টারসেক্স ব্যক্তিদের যৌনাঙ্গ নারী বা পুরুষের থেকে আলাদা। এদের যৌনাঙ্গ পুরুষ বা নারী হিসাবে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।

বিজ্ঞাপন
আমাদের অধিকাংশের ধারণা- হিজড়া সংস্কৃতি মাত্রই শারীরিকভাবে অর্ধ নারী বা পুরুষ অথবা ইন্টারসেক্স। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়, হিজড়া সংস্কৃতিতে এমন অনেকে আছেন, যারা শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও মানসিকভাবে নারী অথবা শারীরিকভাবে নারী হলেও মানসিকভাবে পুরুষ। গতানুগতিকভাবে একে দেওয়া লিঙ্গের চিত্রের বাইরে বৈচিত্র্যময় লিঙ্গের মানুষগুলোই দলবদ্ধ হয়ে হিজড়া সংস্কৃতিতে বসবাস করেন।
পরিবার ও সমাজের বঞ্চনা, অত্যাচার, বুলিংয়ে জর্জরিত জীবন থেকে মুক্তি পেতে এবং নিজের প্রকৃত জেন্ডার ভূমিকায় নিজেকে সাবলীলভাবে পরিচিত করতে হিজড়া দলে নাম লেখান বৈচিত্র্যময় নারী-পুরুষেরা। হিজড়াগুরুদের ডেরায় শুরু হয় তাদের এক নতুন জীবন, যেখানে বুলিংয়ের কারণ তাদের আচরণ, পোশাক, সাজ অথবা যৌন চাহিদার ভিন্নতা নয়। তবে এমন অনেক বৈচিত্র্যময় নারী-পুরুষেরা আছেন যারা হিজড়া দলের অন্তর্ভুক্ত হননি, একা বা পরিবারের সঙ্গেই জীবনযাপন করছেন। কিন্তু বিভ্রান্তিকর হলেও সত্যি যে, জেন্ডার বা হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে অসচেতনতা এবং বুলিং বা বডি সেমিং সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে প্রতি মুহূর্তে একদম কৈশোর থেকেই এই বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিরা পরিবার-পরিজনের কাছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও গোটা সমাজের মুখেই হিজড়া, মাইগ্যা, হাফলেডিস ইত্যাদি নানা রকম কটুবাক্য শুনে শুনে ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হন। সমাজব্যবস্থার প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে বড় হতে হতে কেউ কেউ হাল ছেড়ে চলে যায় কোনো হিজড়া গুরুর ডেরায়, কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ, আবার কেউবা থেকে যায় পরিবারেই।
ফরিদপুরের হিজরা জনগোষ্ঠীর অবস্থা
ফরিদপুর জেলায় স্থায়ীভাবে অবস্থানরত হিজড়া ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৩৬ জন (আনুমানিক)। এরমধ্যে হিজরাগিরি পেশায় আছেন ১২৭ জন। এর পাশাপাশি অন্যান্য পেশায় আছেন নয় জন। এছাড়া অন্যান্য পেশায় যেতে চান ১২৭ জন। যাদের মধ্যে এসএসসি পাশ করেছেন ১১ জন। আর জাতীয় পরিচয়পত্র আছে ৮৪ জনের।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার যেমন: ঢাকা, রাজশাহী, জামালপুর, যশোরের হিজড়া বা লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সদস্যদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হলেও ফরিদপুরের চিত্র বেশ ভিন্ন। ফরিদপুর জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় শতাধিক হিজড়া ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সদস্য থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের থেকে শুরু করে তাদের জন্য প্রদানকৃত সেবাসমূহ সম্পর্কেও অবগত নন। এমনকি হিজড়া ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও যে সমাজের বাকি দশজন মানুষের মতো বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে সেটিও তাদের ভাবনার বাইরে। ফলস্বরূপ কয়েকজন ব্যতীত এরা সকলেই হিজরাগিরি পেশায় নিয়োজিত।
তবে এদের মাঝে কয়েকজন হিজড়া পরিচয় নিয়েই ব্যবসা ও চাকরি করছেন। মিলেছে কয়েকজন এসএসসি ও এইচএসসি পাশ। এমনকি অনার্স পড়ুয়া বৈচিত্র্যময় নারীর তথ্যও মিলেছে। তাদের স্বপ্ন ছিল- লেখাপড়া শেষে করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু শারীরিক বৈচিত্র্য নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে এখন নিজেদের শারীরিক বিকলঙ্গ ভেবে সকল স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে নেমেছেন পথে। কিছু অদ্ভুত তথ্যও উঠে এসেছে তালিকায়- যেমন: একই পরিবারের আপন দুবোন হিজড়াগিরি পেশায় আছেন একই গুরুমায়ের ডেরায় (হিজড়াদের বাসস্থান)। আছেন আপন চাচা-ভাস্তেও। হিজরা জনগোষ্ঠীর যে সকল সদস্যরা তুলনামূলক অনুন্নত এলাকাগুলোতে বসবাস করেন, তারা নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। যেমন: তারা যৌনাঙ্গ বা স্তন ট্রান্সপ্লান্টের জন্য অনিরাপদ সেবা গ্রহণ করেন যা কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ব্লাস্ট, বন্ধু, লাইট হাউজসহ যে সকল প্রতিষ্ঠান হিজড়া ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে বিভিন্ন সেবা প্রদান করে থাকে সে বিষয়ে অনেকের মধ্যে সাধারণ ধারণাও নেই। অসচেতনতা ও না জানাগুলো থেকেই যতটুকু সেবা বা গ্রহণযোগ্যতা আছে সেটা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।

হিজড়াগিরি পেশায় গুরুমার ছত্রছায়ায় থেকেও অনেক হিজড়া এই পেশা ছেড়ে সম্মানজনক কাজ করতে চান। কিন্তু বাধ সাধে সমাজ ব্যবস্থা, কেননা নানা কারণে চাইলেই একজন হিজড়াকে কেউ কাজে ডাকবে না। অন্যদিকে তারা কী ধরনের কাজ করতে চান জানতে চাইলে জানান, হিজড়ারা দীর্ঘসময় ধরে পথে ঘাটে হেঁটে, হাততালি দিয়ে পয়সা উপার্জন করেছে। কিন্তু তাদের জন্য যে সকল কাজের ব্যবস্থা থাকে সেগুলো ঘরকেন্দ্রিক, ফলে তারা মানসিকভাবে এইসকল কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।
ফরিদপুর সদর উপজেলার শাপলা হিজড়া বলেন, আমাদের জন্য খামার করা, বাগানী অথবা প্রহর এরকম কাজ করা সহজ, সারাজীবন রাস্তায় রাস্তায় কালেকশন করে কাটিয়েছি এখন, সেলাই মেশিনে বসার মতোন মন-মানসিকতা নেই। অন্যদিকে, কুমকুম (ছদ্মনাম) হিজড়া বলেন, আমাদের জন্য বিউটি পার্লারের প্রশিক্ষণের সুযোগ আসে, কিন্তু আমরা পার্লার খুলে বসলে কতজন ক্রেতা আমাদের কাছে আসবেন সেটা কেউ ভেবে দেখেন না, রাস্তা-ঘাটে হিজড়া দেখেই সবাই ভয় পায়, সেখানে টাকা দিয়ে আমাদের সেবা গ্রহণ স্বপ্নের মতো। তবে যদি আমরা সুন্দর আচরণ ও বেস্ট লেভেলের কাজ করতে পারি তখন ক্রেতারা আসবেন। কিন্তু সেই দিন এখনো অনেক দূরে, গণহারে সাধারণ প্রশিক্ষণে এটা সম্ভব নয়।
সত্যিকার অর্থেই হিজড়া বা লিঙ্গ বিচিত্রয় জনগোষ্ঠীর সদস্যদের দিনের পর দিন যেরকম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেখানে তাদের মধ্যে জীবনকে নতুন করে সাজানোর স্বপ্ন দেখা বেশ কঠিন। তাই ধৈর্য ধারণ করে, মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করাটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং। এ জন্য ইচ্ছা এবং দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও হিজড়াগিরি পেশায় থেকে যায় অনেকেই।
ফরিদপুর জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে থাকার পেছনে যেসব বিষয় কাজ করে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ সরকারি ও বেসরকারি সেবা গ্রহণে ভীতি বা অনীহা। সরকারি লোক মানেই হিজড়া পেশা উচ্ছেদ ও বেসরকারি লোক মানেই হিজড়াদের ছবি বেচে বিদেশি পয়সা খাওয়ার ধান্দা- এই বিরূপ চিন্তা-ভাবনা তো আছেই। পাশাপাশি নিজেদের একরকম অস্পৃশ্য ভেবে নিয়ে তারা মূল স্রোতে আসতে সংকোচ বোধ করেন। যদিও দিন দিন এই বরফ ভাঙছে, এগিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী তাদের স্ব স্ব যোগ্যতা, কিন্তু সে সংখ্যাটিও খুব বেশি বড় নয়।
এ ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো হলো- সামাজিক ও পারিবারিক অগ্রহণযোগ্যতা এবং বাসস্থানের অভাব; পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া; অধিকার ও সরকারি-বেসরকারি সেবা সম্পর্কে অজ্ঞতা; সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা ও নেটওয়ার্কিং সম্পর্কে ভীতি; স্কুল পর্যায়ে ঝরে পরা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে কটাক্ষের শিকার হওয়া; স্বাস্থ্যঝুঁকি ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বাধা; জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা ও সরকারি দফতরগুলোর অসহযোগী মনোভাব; হিজড়া পেশার নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম এবং চেহারার অমিল; এওয়ার্নেস ও কাউন্সিলিংয়ের অভাব; কর্মদক্ষ হতে অনাগ্রহী ও প্রশিক্ষণের সুযোগের অপ্রতুলতা; আচরণগত জ্ঞ্যানের অভাব ও সহনশীল মনোভাব তৈরির সুযোগের অভাব; আইনগত সেবা গ্রহণে ভীতি ও অজ্ঞতা; সাইবার বুলিং, যৌন সহিংসতা ও ব্লাকমেইলের শিকার হওয়া।
এসব সমস্যা সমাধানে করণীয়গুলো হলো- সমাজের সকল ধারায় জেন্ডার সম্পর্কে এওয়ার্নেস বিল্ডাপ; ভিকটিমদের কাউন্সেলিং; সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা; সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা; প্রশাসনের সক্রিয়তা; ট্রেইনিং ও কাজের সুযোগ; বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর শিক্ষা/কর্ম পরিবেশ তৈরি।
লেখক: তাহিয়াতুল জান্নাত রেমি, সভাপতি, নন্দিতা সুরক্ষা।
বিএইচআর/আইএইচ

