শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান লেখেন বাউল কামাল পাশা

আল-হেলাল
প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২২, ০৭:৫৮ এএম

শেয়ার করুন:

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান লেখেন বাউল কামাল পাশা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন আর শুধু একক ব্যক্তিসত্ত্বায় আবদ্ধ নেই। তিনি এখন বাংলাদেশের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখন ব্যাপকভাবে গবেষণা হচ্ছে। বই লেখা হচ্ছে। লেখা হচ্ছে গান। তৈরি করা হচ্ছে চলচ্চিত্র। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে সৃষ্ট অনেক কর্ম জাতির পিতাকে ভালোবেসে রচিত হলেও, বঙ্গবন্ধু-তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারে থাকায় অনেকে সুবিধা নিতেও বই-পুস্তক লেখে থাকেন। ফলে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি কথা সব সময় বলে থাকি যে, বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই- অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়া চীন-ই যথেষ্ট। 

এর বাইরে যদি পড়তেই হয়, তাহলে ঐসব বই পড়তে হবে যা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় লেখা হয়েছে বা বিদেশিরা লিখেছেন। কিন্তু, এর বাইরেও একটি কথা থেকে যায়। সেটি হলো তাদের কথা যারা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত করেছেন। যারা বঙ্গবন্ধুর খ্যাতি-যশ লাভের আগেই ভালোবেসে তার নামে গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, বই লিখেছেন, জেলে নেওয়ার প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু তাদের নাম ইতিহাস মনে রাখেনি। কারণ তখন আজকের মতো প্রদর্শনীর দুনিয়া ছিলো না। ছিলো না নিজেকে জাহির করার ইচ্ছা। আর ইচ্ছা থাকলেও তখন আজকের মতো প্রদর্শনেচ্ছার প্লাটফর্ম ছিলো না।


বিজ্ঞাপন


১৯০১ সালে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় জন্মগ্রহণ করা বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন) তাদেরই একজন। যিনি তার সঙ্গীত জীবনের যৌবনে বঙ্গবন্ধুর প্রেমে পড়েন এবং লিখে যান একের পর এক গান। কিন্তু মিডিয়ার অভাবে বা নিজেকে গুটিয়ে রাখার স্বভাবে তিনি নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। ফলে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম তার থেকে বয়সে ছোট এবং দেরীতে বাউল জীবনে প্রবেশ করলেও জাতীয় স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন। কিন্তু, কামাল নামটি হয়তো অনেকে জানেনই না।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেটে জানা যায় বাউল কামাল পাশাই (কামাল উদ্দিন) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান রচনা করেন। ঐতিহাসিক তথ্যমতে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিনের ঘোষণা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে বন্দি থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ দাবিতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। এবং মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর শহীদ হন।

bangabandhu

বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। একটানা ১৩ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। জেলখানা থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে তাকে ঢাকা জেলখানা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি পিকিং-এ বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন।


বিজ্ঞাপন


বঙ্গবন্ধুর অনুপুস্থিতিতে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার ভুরাখালি গ্রামের আব্দুস সামাদ আজাদ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উজানীগাঁও জয়কলসের সোনাওর আলী, তাহিরপুর থানার বড়দল গ্রামের মেডিকেল ছাত্র ডা. হারিস উদ্দিনসহ আরও অনেকে।

এরই মধ্যে, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার কৃতিসন্তান প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমানের পত্র পেয়ে সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ মহকুমা শাখা গঠন করা হয়। এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন সুনামগঞ্জের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক আব্দুল হাই হাছন পছন্দ। উক্ত আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য দিরাই থানার ভাটিপাড়া নিবাসী আবুল হাশিম চৌধুরী দিরাই থানা সফর করে সেখানেও একটি কমিটি গঠন করেন। এবং দিরাই থানা কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত করেন বাউল কামাল পাশাকে (কামাল উদ্দিন)। কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন দিরাই থানা কমিটিতে আরও যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন ভরারগাঁও-এর আব্দুন নূর মাস্টার, হাতিয়ার মৌলানা ছাদিকুর রহমান, ছাতকের চেচান নিবাসী মতছিন মিয়াসহ আরও অনেকে। 

কিন্তু বাউল কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন ভাষা সংগ্রাম পরিষদ দিরাই থানা কমিটি থানা সদরে কার্যত কোনো সভা করতে পারেনি পুলিশের দমন পীড়নের ভয়ে। পরে তারা ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দিরাই থানা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী রাজানগর কেপিসি হাইস্কুল মাঠে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে একটি প্রতিবাদ সভা করেন। ঐ সভাতে বাউল কামাল পাশা নিজেই সভাপতিত্ব করেন। এবং তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে ৩টি গান পরিবেশন করেন। এর মধ্যে প্রথম গানটি হলো যেখানে তিনি শেখ মুজিবের নাম উল্লেখ করেন:

‘ঢাকার বুকে গুলি কেন? নুরুল আমিন জবাব চাই
ওরে উর্দ্দূ প্রেমে মন মজাইয়া, মারলো কতো শহীদ ভাই।
ওরে উর্দ্দূ প্রেমে মন মজাইলো, করলো কত রং বড়াই।।
শেখ মুজিব কারাগারে, আন্দোলন কেউ নাহি ছাড়ে
সত্যাগ্রহে এক কাতারে, সামনে আছেন সামাদ ভাই।।
ওয়ান ফৌরটি ফৌর জারী করলো, নির্বিচারে ছাত্র মারলো
কত মায়ের বুক খালি হইলো, সে কথাতো ভুলি নাই।।
সালাম বরকত রফিক জব্বার হলেন শহীদ বাংলাভাষার
একটাই দাবী কামাল পাশার, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ।।’

গবেষকদের মধ্যে সাংবাদিক সুমন কুমার দাশ ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় তার লেখা ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম লেখা গান ও শাহ আব্দুল করিম’ কলামে বাউল সম্রাট আব্দুল করিমকে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গানের গীতিকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এদিকে গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস ১৬ অক্টোবর ২০২০ সমকাল পত্রিকায় ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান শিরোনামে’ লেখায় দাবি করলেন শাহ আব্দুল করিম নন গোপালগঞ্জের সংগীত সাধক শেখ রোকন উদ্দিন সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংগীত রচনা করেছেন। 

এক্ষেত্রে গোপালগঞ্জের গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখিত প্রথম গান হিসেবে নিচের গানটি উল্লেখ করেন:

“ধান কাটিতে গেলামরে ভাই খুলনা জেলার পরে
ওরে গোডাউনে ধান উঠাইলো কন্ট্রোলের ব্যাপারে।
আইলাম সবে বাড়ি ফিইর্যা মহাজনের দেনায় পইড়্যারে।।
ওরে ঘরবাড়ি সব দিলাম ছাইর্যা, রাস্তায় রই শুইয়ারে।।
চাষী মরছি না খাইয়্যা।।
শেখ মুজিবর বলেছিল ছেড়ে দেগো ধান
ওরে আমার দেশের দাওয়াল ভাইরা ভিক্ষা দাওরে প্রাণ।
জালিম সরকার ধান না দিয়া মুজিব ভাইরে নিল ধইর্যা।
তারে ৩টি বছর জেলে রাখলো, বিচার না কইর্যা।।
চাষী মরছি না খাইয়্যা ”।।

এই গানটি বিশ্লেষণ করলে পরিস্কার অনুধাবন করা যায় যে, গানটি মূলত বঙ্গবন্ধুর ৩ বছর জেল মুক্তি লাভের পর লেখা হয়েছে। আর যেহেতু বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হন। সেহেতু গানটি কমপক্ষে ৫২ সালের শেষের দিকে বা ৫৩ সালের শুরুর দিকে লেখা হয়েছে। অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে বাউল কামাল পাশা গানটি লেখেন ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম লেখা গানের গীতিকার শাহ আব্দুল করিমকে সাব্যস্ত করতে সাংবাদিক সুমন কুমার দাশ যে গানটি উল্লেখ করেছেন তা ১৯৫৪ সালে লেখা। গানটি হলো:

পূর্ণচন্দ্র উজ্জল ধরা, চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা
জনগণের নয়নতারা শেখ মুজিবুর রহমান
জাগো জাগরে মজুর কৃষাণ।।

তবে, আমি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নই, গানটি আদৌ শাহ আব্দুল করিমের লেখা কিনা। ভাষা সৈনিক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ তার জীবদ্দশায় বাউল কামাল পাশা সম্পর্কে প্রায়ই বলতেন যে, ৫২’র ভাষা আন্দোলনের আগে থেকেই বাউল কামাল পাশা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিভ্রমনকারী একজন ভ্রাম্যমান বাউল শিল্পী ছিলেন। এখন পর্যন্ত তার নিজের লেখা ৫০টি গানের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার অধিকাংশই বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ও দেশাত্ববোধক গান। রাজধানী ঢাকা, কেরানীগঞ্জ বা মানিকগঞ্জ অঞ্চলে কোন বাউল গানের প্রোগ্রামে আসা যাওয়ার পথে তিনি ঢাকায় অবস্থানরত সুনামগঞ্জের ছাত্রদের মেসে উঠতেন। 

সামাদ সাহেব বলতেন, ‘আমরা সুনামগঞ্জী ছাত্ররা তাকে মেসে মেহমান হিসেবে সম্মানের সাথে রাখতাম এবং অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করতাম।’

তাই, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মাতামাতির এই ডিজিটাল যুগে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে যারা নিঃস্বার্থভাবে এনালগ যুগে কাজ করে গেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেছেন, তাদেরকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। পাশাপাশি তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাও আমাদের দায়িত্ব। আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান রাখতে চাই যেনো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম গানের কৃতিত্ব হাওড়পারের বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন) কে দেওয়া হয় এবং তাকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়।

লেখক: আল-হেলাল, প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক, বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদ সুনামগঞ্জ।

এসএএস/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর