শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শোক আজ শক্তিতে রূপান্তরিত

জেসমিন সুলতানা
প্রকাশিত: ১৩ আগস্ট ২০২২, ০৯:৪৪ এএম

শেয়ার করুন:

শোক আজ শক্তিতে রূপান্তরিত

আগস্ট সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য শোকের মাস, হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মাস, প্রিয়জন হারিয়ে ব্যথাতুর হৃদয়ের ক্রন্দনের মাস। ১৫ আগস্ট আমরা হারিয়েছি সর্বকালের, সর্বহৃদয়ের, সর্বশ্রেষ্ঠ  মহামানব, বাঙালি জাতির নেতা, স্বাধীনতার স্বপ্ন দ্রষ্টা, দিকনির্দেশক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শত যুগ পরেই এমন মহামানবদের আবির্ভাব হয় পৃথিবীর বুকে। যারা মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থায়ীভাবে আসন পেতে থাকেন।
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা পূর্ব তিনদশক কাটিয়ে দিয়েছিলেন জেল, জুলুম, অত্যাচারের ভেতর দিয়ে। তার  চিন্তা চেতনা, মনন ছিলো বাঙালি জাতির কল্যাণে।  

‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীর ভাবে ভাবায়। এই যে নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ -অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান।


বিজ্ঞাপন


তিনি ভাবতেন বাঙালির কথা। সূর্য যেমন তার অফুরন্ত দীপ্ত রশ্মি জ্বেলে সমগ্র বিশ্বকে উদ্ভাসিত করে তেমনি বাঙালি জাতিকে নিজস্ব সত্ত্বা নিয়ে মাথা সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য সূর্যের ন্যায় আলোক বর্তিকা হাতে এসেছিলেন  মহাপুরুষ, সিংহ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের মহানায়ক তিনি। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন বদ্বীপ সৃষ্টিতে তার অবদান অস্বীকার করার অর্থ হলো নিজের জন্মকে ও অস্তিত্ব অস্বীকার করা। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বার বার কারাবরণ করেছেন। চার হাজার ছয়শত বিরাশি দিন, প্রিয়জনকে না পাওয়ার বেদনায় বেদনাতুর ছিলো তার পরিবার ও গোটা বাংলাদেশ। তিনি চেয়ে ছিলেন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির মুক্তি, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী জীবনাচরণের সর্বোপরি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৯৪৩ সন থেকে স্বকীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার পর থেকেই তার চিন্তা, চেতনায় ছিলো অসহায় দুঃখী বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। তিনি করেছিলেনও তাই। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধে। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আড়াই লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যখন এগিয়ে চলছিলো উন্নয়নের পথে সে সময় স্বাধীনতার ৩ বছর সাত মাসের মাথায় দেশি ও বিদেশিদের চক্রান্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল ক্ষমতা লিপ্সু, বিপথগামী হায়েনার দল স্বপরিবারে হত্যা করে বাঙালি জাতির প্রাণ বাংলাদেশ ও স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের ২৬ জন সদস্যকে। 


বিজ্ঞাপন


এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি জাতির কপালে এঁকে দেয় তারা কলংকের কালো তিলক।

ঘাতকদের মূল টার্গেট ছিলো বঙ্গবন্ধু পরিবার। নিকটাত্মীয়সহ ২৬ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতির ইতিহাসে কালো অধ্যায়ের রচনা করে তারা। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। হত্যা করেছে মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে যিনি নিভৃতে থেকে দিয়েছিলেন শক্তি আর প্রেরণার আলোক বর্তিকা।

বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ পারভীন জামাল রোজী, সুলতানা কামাল,  বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বর্তমান আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশও ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এর পিতা শেখ ফজলুল হক মনি এবং মাতা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার কন্যা বেবী সেরনিয়াবাদ, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সহীদ সেরনিয়াবাদ, আত্মীয় রিন্টু খান, এস বি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক কেউ বাদ যায়নি তাদের পিশাচদের হাত থেকে।

তবে রাখে আল্লাহ মারে কে? বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের স্বপ্ন সারথি, আমাদের বাতিঘর, বাঙালিদের অন্তঃপ্রাণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছোট বোন শেখ রেহানাকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলেন অকৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির হাল ধরার জন্য।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্ব পরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই বন্ধ থাকেনি গভীর ষড়যন্ত্র। পৈশাচিক নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর দেশ চলে যায় নষ্টদের দখলে। চরিত্রহীন, নৈতিকতাহীন, পিতামাতাহীন, দেশপ্রেমহীন, উদ্বাস্তুর দল আরোহন করে ক্ষমতায়। খুনী জিয়া, মুশতাকের দল অসাংবিধানিক উপায়ে অবৈধ পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেই বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পাশ করে ঘৃণ্য, জঘন্য, কালো আইন ইন্ডিমিনিটি বিল।

তারা জাতির পিতার খুনিদের, স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আলবদরদের মন্ত্রী বানিয়ে, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরী দিয়ে, পদায়িত করে আশ্রয়, প্রশ্রয় দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। 

পারেনি নিকৃষ্ট, ক্ষমতালিপ্সুর দল তাদের কালো আইনকে কার্যকর করতে। বাঙালি জাতির দিশারী বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকার গঠন করে ঘৃণ্য, জঘন্য কালো আইনটি বাতিল করেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার। বঙ্গবন্ধুর নিবেদিত প্রাণ বিজ্ঞ আইনজীবীগণ সুন্দরভাবে দক্ষতার সাথে মামলা পরিচালনা করেছেন, ঘাতকদের বিচার হয়েছে, ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
বিচারের রায় কার্যকর হওয়ায় বাঙালি কিছুটা হলেও দায়মুক্ত। বর্তমানে কিছু পলাতক বিভিন্ন দেশে ফেরারী হয়ে পালিয়ে আছে তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মাধ্যমেই জাতি সম্পূর্ণ দায় মুক্ত হতে পারে। আজ একটি প্রশ্ন মাথায় কেন তাদের এনে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানো যাচ্ছে না। 

১৫ আগস্ট জাতীয় শোকের দিন। এ শোক আজ শক্তিতে রূপান্তরিত।। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করছেন। দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের দুর্বার গতিতে।

কিছু চোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী, বালুখোর, অসৎ লোক না থাকলে দেশ আজ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ  উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতো।

আমাদের প্রিয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা টোল আদায় হচ্ছে। স্বপ্নের  সেতু পার হয়ে প্রতিদিন  হাজারো মানুষ ভিড় করছে বাঙালির পীঠস্থান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মাজারে। সবাই মহান আল্লাহ পাকের দরবারে হাত তুলে প্রাণভরে দোয়া করছে। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি আজ প্রতিটি বাঙালির  কাছে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভালোলাগার স্থান। হায়রে ঘাতকের দল তোরা বুঝতে পারিসনি ঢাকা শহরে বঙ্গবন্ধুর সমাধি হলে এতো লোক কোথায় দাঁড়াতো প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন। স্বপ্নের সেতু পার হয়ে হাজারো বাঙালির গন্তব্য আজ ঐ পূণ্যভূমিতে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিবেদিত প্রাণ। তিনি তার লক্ষ্য স্থির করে দূর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই  নিজস্ব অর্থায়নে হয়েছে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ, আশ্রায়ন-১, প্রকল্পে সোয়া লাখ,  আশ্রায়ন-২ প্রকল্পে বত্রিশ হাজার চারশ নয় জন গৃহহীনে গৃহ দান, জমি দান, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, বিদ্যুতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা, পাতাল ট্রেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে ইন্টারনেট সুবিধা, করোনা সময়েও শতভাগ শিক্ষায় সফলতা, দারিদ্র সংকট মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়নও সফল বাস্তবায়ন, কাউকে অপরাধে ছাড় না দেওয়া, গোদের উপর বিষফোঁড়া দশলাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দান তাদের ভরনপোষণ, মাদক বিরোধী অভিযান, সন্ত্রাস ও জঙ্গী বিরোধী অভিযান, দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স, কোটি কোটি বাঙালিকে করোনা প্রতিরোধ টিকা প্রদানসহ সব ক্ষেত্রেই তিনি সফল।
 
সব কিছুতেই সজাগ ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি রয়েছে স্বপ্নদ্রষ্টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সব শুভদৃষ্টি, সব ভালোবাসা, সবটুকু স্নেহ উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন বাঙালির জন্য। তিনি শুধু সরকার প্রধানই নন তিনি মানবিক গুণ সম্পন্ন অনন্য ও অসাধারণ এক  বিরল ব্যক্তিত্ব। গণ মানুষের নেতা বলেই একজন মানুষকেও করোনা মহামারীতে না খেয়ে, না পরে মরতে হয়নি, বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারাপৃথিবী জুড়েই অস্থিরতার কারণে তেল ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, যার প্রভাব আমাদের  দেশে আসবে এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি জাতি সব পারে, সবংসহা জাতি এসব সামান্য প্রতিকূলতাও কাটিয়ে উঠবে বাংলাদেশ। মিথ্যা অনেকে দিবা স্বপ্ন দেখছেন ক্ষমতায় যাওয়ার, নষ্টদের হাতে হারাবে না বাংলাদেশ।

জাতিকে মিথ্যা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না করে সবাই সত্যকে তুলে ধরুন। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সবাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।

১৫ আগস্টে উপলক্ষে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই দিনে নিহত মহান শহীদদের। সারা পৃথিবী শ্রদ্ধাভরে স্মরন করছে স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে। এ শোক আজ মহাশক্তি, সে শক্তিতে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলুক সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, শ্যাম কুন্তলা, সাগর মেঘলা আমার সোনার বাংলাদেশ।

শোক দিবস উপলক্ষে সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সকল মহান শহীদদের আল্লাহ পাক জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। 

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।


এআইএম/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর