বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বাংলা সিনেমার সুদিন আবার ফিরুক

বিল্লাল বিন কাশেম
প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০২২, ০৯:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

বাংলা সিনেমার সুদিন আবার ফিরুক

সম্প্রতি পরপর দুটি সিনেমা দেখলাম হলে বসে। এর মধ্যে একটির নাম ‘পরাণ’ ও অপরটি ‘হাওয়া’। বাংলা সিনেমা হলে বসে দেখেই আমরা বড় হয়েছি এবং বিনোদন নিয়েছি। তবে গত কয়েক বছর সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয় না বললেই চলে। আলোচনা বা সমালোচনা করবো বা সবাই দেখছে তাই আমিও দেখতে গিয়েছিলাম সে-রকম একটা বিষয়ও বটে। তবে ভালো আর্ট ফিল্ম হলে এখনও মধ্যবিত্তরা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে। তবে এ কথা সত্যি, আমাদের হলে সিনেমা দেখা দর্শকদের বেশিরভাগই নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের টার্গেট করেই সিনেমা বানানো হয়। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ার ফলে বা বিনোদনের মাধ্যম পরিবর্তিত হওয়ায় এখন দর্শকের রকমফের হয়েছে। আর এখন আগের মতো হলও নেই বললেই চলে। সমসাময়িক সময়ে বাংলা সিনেমা দেখতে সিনেমা হলে দর্শক এত হবে এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তারপরও জীবনধর্মী দুটি বাংলা গল্পের চিত্রনাট্যের ফরম্যাটে এত দর্শকপ্রিয়তা পাবে সেটাও অবিশ্বাস্য। সিনেমা আসলে বাস্তব জীবনের রিফলেকশনও বটে। একটা দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় তার কৃষ্টি-কালচারে ফুটে ওঠে।

‘হাওয়া’ সিনেমাটি স্বল্প বাজেটে সাধারণ একটি গল্পকে নিয়ে চিত্রায়িত। ‘হাওয়া’ বলতে হবে অসাধারণ। এস টি কলরিজের 'দ্যা এনসিয়েন্ট মেরিনার' গল্পটির সাথে কিছু মিল অবশ্য পেলাম। এখানে রোমান্টিসিজম এর সাথে সুপারন্যাচারাল যুক্ত কিছু বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে এটা আমাদের (বাঙালিয়ানা) নিজেদের মতোই। গল্পে যে অশ্লীল শব্দোচ্চারণের কথা বলা হচ্ছে তা জেলে সমাজে সাধারণভাবে ব্যবহৃত। আমাদের জেলে সমাজের প্রচলিতভাবে দেখলে বা তাদের জীবন চরিত অবলোকন/চোখে গল্পটি দেখলে সাধারণ বলেই বিবেচিত হবে বৈকি। যদি হলিউডে এটি নির্মিত হতো তাহলে এটার দৃশ্যায়ন ভিন্নরকম হতো বৈকি। আমি বলবো, অসাধারণ নির্মাণ। তারপরও শেষের দিকে যে মিথ (সাপ) আনা হয়েছে সেটা না করে ভিন্নভাবেও করা যেতে বৈকি! গল্পে আরও মনোযোগ ও চিত্রনাট্য সহজবোধ্য করা দরকার ছিল। দৃশ্যায়ন প্রায় সবই অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। শুরুটা বলতে হবে দারুণ। একটা ঘাট এলাকা যেমন হওয়া দরকার তার স্টার্ট ঠিকই। তবে এন্ডিংটা রোমাঞ্চকর তেমনটা ছিল না। তারপরও বাংলার মানুষের নিজস্ব গল্পে এমন প্রেক্ষাপট ও দর্শক মুগ্ধকর হবে এটাও কম কথা নয়। বাংলা বাঙালির হোক, বাংলার জয় হোক। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের পাঁচ মিনিটের একটি মুভি অস্কারসহ অনেকগুলো পুরস্কার জিতে নিয়েছে। এ মুভিটির কথাও বা গল্পটি কিন্তু সরল।


বিজ্ঞাপন


দুই.

বাংলা সিনেমা নিয়ে সমালোচনা করার মতো যোগ্যতা হয়তো আমার নেই। তবে কমিউনিকেশনের ছাত্র হিসেবে বা ক্লাসরুমে সিনেমা নিয়ে আমাদের সমালোচনা ছিল একটি পার্ট। একজন দর্শক হিসেবে যদি বলি, সিনেমাটার মেকিং ভালোই লেগেছে। আর গল্পটাতে যে বাস্তবের কোনো ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে সেটা তো সবারই জানা। তবে সিনেমাটা দেখে একটা বিষয় মনে হয়েছে, বাংলা গল্প বা আমাদের একান্ত নিজস্ব গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মান করলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শক হলে ফিরবে। লাইভ টেকনোলজি যে যাত্রা শুরু করেছে বা রায়হান রাফির মতো তরুণ নির্মাতারা চলচ্চিত্রে যুক্ত হলে বাংলাদের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি ওঠে দাঁড়াবে। কারণ মেকিং নিয়ে সমালোচনার জায়গা রাখেননি পরিচালক। বাংলা সিনেমায় যেটার অভাব সবচেয়ে বেশি। সাউন্ড, মিউজিক, স্ক্রিনিং বেশ দক্ষভাবে করেছেন। মানে দর্শক হিসেবে একটা ভালো মানের সিনেমার দেখতে পাবেন। পুরো সিনেমা দেখে মনে হবে না জোকারি কিছু দেখছেন, বরং বেশ কিছু জায়গায় সেনসেশন সৃষ্টি হবে। এর পরে কি হবে?

এছাড়া রাজের অভিনয় দেখে মনে হয়েছে তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে রাজ করতেই এসেছেন। একজন নেশাগ্রস্ত মানুষের চরিত্রটি দুর্দান্ত দেখিয়েছেন। যার চরিত্রটির গল্পের প্রতি মায়া সৃষ্টি করেছেন পরিচালক। সবমিলিয়ে  বেশ ভালো একটা সিনেমা যদি বাস্তবের কোন গল্পে মিল না খুঁজি। তবে বাস্তব দিক থেকে যদি দেখি গল্পের কিছু জায়গা মনে হয়েছে দর্শককে স্পর্শ করতে পারে নি। কিংবা কোনো বিশেষ কাউকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্টোরি টেলিং শুরুর দিকে ঝুলে গেছে, বোরিং লাগছিল। ক্লাইম্যাক্সে ঢুকতে এক ঘণ্টা লেগে গেছে। বিরতির পরে খানিকটা জমেছে। অভিনয় যদি বলি শরিফুল রাজের অভিনয় দুর্দান্ত লেগেছে। মঞ্চ অভিনেতা মামুন অপু ওরফে তোতা মিয়া তার অভিনয় তো বরাবরই হিট। তবে প্রধান যে চরিত্র নায়িকার অভিনয় সেটা খুব আশাজনক ছিল না। চরিত্র যতটা ফুটিয়ে তোলা দরকার ছিল ততটা ফুটে ওঠেনি। একটা ভাসা ভাসা উচ্চারণের কারণে ডায়লগগুলো টইক সামঞ্জস্য হয়নি।

প্রথমত, অনেক দিন পর কোনো বাংলা সিনেমা নিয়ে যে সমালোচনা করা যাচ্ছে, দর্শক হিসেবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে সেটাই পরিচালকের অনেকখানি সার্থকতা বলেই মনে করি। পরিচালক গল্পটা কীভাবে শুরু করবেন সেটা তার নিজস্ব ভাবনা। কিন্তু দর্শক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, শুরুটা একটু অন্যভাবে করা যেতো। থানায় অনন্যার জিজ্ঞাসাবাদ দিয়ে শুরু করতে গিয়ে তার পাশফেল ও পড়াশুনা নিয়ে বেশ একটা সময় ব্যয় হয়েছে। ফলে শুরুর দিকে গল্পটা বোরিং মনে হচ্ছিল। নরমালি মঞ্চনাটকের পরিবেশনাগুলো যেভাবে এগোয় সিনেমার গল্পটাও ঠিক সেভাবে এগিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল গল্পটা অনন্যা আর তার বাবার আদালত পাড়া হাঁটা, মিডিয়ার হৈ হৈ এসব দিয়েও শুরু হতে পারতো। পরে জিজ্ঞাসাবাদ দিয়েও যাওয়া যেতো। সিনেমাটিতে কাউকেই ঠিক অপরাধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় নি। হিরো হিসেবে পুরো সিনেমাতেই রাজকে উপস্থাপন করা হলেও শেষ সময়ের টুইস্টাতে মনে হয়েছে খুব তাড়াহুড়া করা হয়েছে। রোমান তথা রাজের পরিণতির বিষয়টি আর একটু টাচি হতে পারতো।


বিজ্ঞাপন


তবে সিফাত মিন্নির সম্পর্কের জেরে বাস্তব হত্যাকাণ্ডের যে ঘটনা সেটাকে পুরোপুরি ধারণ করেনি ‘পরাণ’। গল্পের মোড় পরিবর্তন করা হলেও সিফাত হত্যার পুরো ঘটনাটাই সিনেমায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবের ঘটনার সাথে তুলনা করে সিনেমাটা দেখলে বেশ কিছু জায়গায় ঘাটতি মনে হবে। বিশেষ করে কলেজ গেটে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মিন্নির যে ভূমিকা পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দা যেসব তথ্য বেরিয়ে আসে সেগুলোর খানিকটা পরিবর্তন রয়েছে। সর্বোপরি, বাস্তব ঘটনার সাথে না মিলিয়ে সিনেমা হিসাবে দেখলে ‘পরাণ’ খুব ভালো সিনেমা। তবে একজন সমালোচক হিসেবে আমি বাস্তব ঘটনার অন্তরালের কোনো অজানা সত্য জানার জন্য গেছিলাম সে দিক থেকে খানিকটা ব্যর্থ হয়েছি। পরিচালক সিরিয়াস গল্পের আড়ালে কমেডি যোগ করতে চেয়েছেন যেটা আমার মনে হয় দরকার ছিল না, পুরোটাই অ্যাকশন ধর্মী করা যেতে পারতো।

তবে সবমিলিয়ে দুই ঘণ্টা বসে সিনেমা দেখলে সময় নষ্ট হবে না বলেই মনে হয়। কারণ মেকিং এবং রাজের অভিনয় আমার দুর্দান্ত লেগেছে। তবে রাজ তথা রোমানকে যেভাবে সন্ত্রাসী বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে সেই তুলনায় তার নেশা করা ছাড়া কোনো হাঙ্গামা কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। ‘পরাণ’ সিনেমাটিতে শরীফুল রাজ অসাধারণ অভিনয় করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। তবে মিন্নীর চরিত্রে মিম এর অভিনয় শৈলী আমার কাছে অতোটা ভালো লাগেনি। সিনেমাটি আমার খুব কাছের ছোট ভাই ইয়াসির আরাফাত, অতুল তামজিদ ও লাইভ টেকনোলজির বড় ভাই শরীফ ভাইকে ধন্যবাদ জানতেই হয়, তারা দেশীয় গল্পে এতো বড় লগ্নি করেছেন। ভালো কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এটাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। আমি তাদেরকে ওভার ফোনে এসব নিয়ে অনেক কথাও বলেছি।

সবশেষে আশার কথা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত মনে হচ্ছে ভালোমানের গল্পনির্ভর সিনেমা হলে বসে ছবি দেখবেন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ও শিল্পীরা আবার ভালো কিছুর দিকে ধাবিত হবে এমনটাই সবাই আশা করেছে। ভালো গল্প ও ভালো মানের সিনেমা হলে সেটা মানুষ খাবে বলেই বিশ্বাস করি।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর