বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটনে অপার সম্ভাবনা

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২২, ০৪:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটনে অপার সম্ভাবনা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প উন্নয়নে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে পদ্মা সেতু ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনে নতুন দিগন্ত। পর্যটনের বহুমুখী সম্ভাবনায় পদ্মা সেতু পাল্টে দিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এখন সুন্দরবন, বাগেরহাট ও কুয়াকাটায়  পর্যটকদের কম খরচে ও কম সময়ে ভ্রমণ সহজ হওয়ায় পদ্মার বুক চিরে চলে যাওয়া দৃষ্টিনন্দন সেতুই যেন নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এবং অনাগত স্বপ্ন পূরণে পর্যটনে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে কেন্দ্র করে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার-স্ট্যাচু অব লিবার্টি,  যুক্তরাজ্যের টেমস নদীর ওপর নির্মিত লন্ডন ব্রিজ, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, চীনের মহাপ্রাচীর, ভারতের তাজমহল ইত্যাদি। ঠিক তেমনি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে  অন্যতম ট্রাম্প কার্ড হবে পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে হংকং-সাংহাইয়ের মতো শহর গড়ে তোলার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ইতোমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে সেতুর দুই পাড়। স্বপ্নের এই সেতু চালুর পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই আসছে অসংখ্য মানুষ। ভ্রমণপিপাসু এসব মানুষের চাহিদা মেটাতে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের যেন আন্তরিকতার কমতি নেই। আতিথেয়তার সবটুকু দরদ দিয়েই পর্যটকদের সেবা দিচ্ছেন তারা। শরীয়তপুরের জাজিরা ও মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে গড়ে উঠছে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠান। জাজিরার নদীশাসন এলাকা নাওডোবা থেকে শিবচরের মাদবর চর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সাড়ে ১০ কিলোমিটার এখন দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র। ইতোমধ্যে জাজিরাতে অলিম্পিক ভিলেজ, এয়ারপোর্ট,আইটি পার্কসহ অনেক স্থাপনার পরিকল্পনা রয়েছে এবং শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গী মোড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে। এমনকি গোপালগঞ্জের  টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতার সমাধি ঘিরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিড় পর্যটনে উঁকি দিচ্ছে নতুন মাত্রা।

পদ্মা সেতুর পর নদীমাতৃক বরিশাল বিভাগজুড়ে পর্যটন শিল্পে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সূর্যোদয় ও সুর্যাস্ত দেখার দেশের একমাত্র স্থান সাগরকন্যা কুয়াকাটা, পায়রা সমুদ্র বন্দর, গঙ্গামতী, বৌদ্ধ মন্দির, রাখাইন পল্লী, দূর্গাসাগর, সাতলার লাল শাপলার বিল, গুঠিয়ার বায়তুল আমান জামে মসজিদ, ঝালকাঠীর ভিমরুলীর ভাসমান পেয়ারার হাট, ভোলার মনপুরা দ্বীপ, চর কুকরি মুকরি, জ্যাকব টাওয়ার, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী পেয়ারা বাগান, আটঘর আমড়া বাগান, কবি আহসান হাবীবের বাড়ি, বরগুনায় ফাতরার বন, সোনারচর, হরিণঘাটা, লালদিয়ার বন ইত্যাদি পর্যটনে হাতছানি দিচ্ছে।

পদ্মা সেতুর কল্যাণে খুলনা বিভাগের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবন ও ষাট গম্বুজ মসজিদ, কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট, খানজাহান আলী সেতু ও বড় দীঘি, জাতিসংঘ পার্ক, দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স, রূপসা নদী, শহীদ হাদিস পার্ক, খুলনা শিপইয়ার্ড, গল্লামারী স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমি, পিঠাভোগ, প্রেম কানন, বকুলতলা, মংলা পোর্ট, রাড়ুলী, মিস্টার চার্লির কুঠিবাড়ি, সেনহাটি, সোনাডাঙ্গা সোলার পার্ক ইত্যাদিতে পর্যটনে ব্যাপক প্রসার ঘটবে।

বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সুন্দরবন ও ষাট গম্বুজ মসজিদ থাকা সত্ত্বেও পর্যটনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পিছিয়ে থাকার কারণ হলো- সদিচ্ছা, প্রশাসনিক কাঠামো, পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা ঘাটতি ছাড়াও দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা। এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যেই সম্ভাবনার বারতা নিয়ে এসেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যাকে অবলম্বন করে শুধু ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ মসজিদ নয় বরং কুয়াকাটা, মোংলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলো পর্যটন করিডোরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অপরদিকে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হঠাৎ ট্যুরিস্ট ফ্লো বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দুর্বল পর্যটন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে। এমতাবস্থায় এসব ভালো-মন্দের ভারসাম্য রক্ষা করে পর্যটন উন্নয়নে এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই দেশকে পর্যটনে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।


বিজ্ঞাপন


পদ্মা সেতুর পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে করণীয়

পদ্মা সেতুর উভয় প্রান্তে ভিজিটর সেন্টার, পদ্মা পাড়ের দৃশ্য অবলোকনের জন্য ওয়াচ টাওয়ার, মানসম্পন্ন বিশ্রামাগার, শৌচাগার, পার্কিং এরিয়া, রেস্তোরাঁ, মানসম্পন্ন রিসোর্ট, কনফারেন্স সেন্টার, এমিউজমেন্ট অ্যান্ড থিম পার্ক, বিজনেস সেন্টার, শপিং আর্কেড, অডিটোরিয়াম, বুক স্টল, ভিজুয়াল লাইব্রেরি, ইনফরমেশন অ্যান্ড কম্পলেইন সেন্টার ইত্যাদি রাখতে হবে। শুধু তাই না, সেতুসহ সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ভ্রমণের জন্য জল, স্থল ও আকাশ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। জলপথে আধুনিক ওয়াটার বাস, স্পিড বোট ইত্যাদি; স্থলপথে খোলা পর্যটক যান এবং আকাশপথের জন্য হেলিকপ্টার রাইড সুবিধা থাকতে হবে। পরিবেশ ও সৌন্দর্য রক্ষার বিষয় চিন্তা করে  অপরিকল্পিত ব্যাঙের ছাতার মতো যেকোনো ধরনের স্থাপনা নিষিদ্ধ করতে হবে। শুধু তাই না, এর পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঞ্চলিক পর্যটন অফিসের কার্যক্রম চালু, স্থানীয় পুলিশ এবং ট্যুরিস্ট পুলিশের সমন্বয়ে সেফটি টিম, স্কাউট, গার্লস গাইড এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, নৈশকালীন বিনোদনের জন্য মুক্তমঞ্চভিত্তিক কালচারাল শো, নিরাপত্তায় সিসি টিভি ও ওয়াচ টাওয়ার, সার্বক্ষণিক তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রের ব্যবস্থা। পরিবেশের ভারসাম্য, পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী ভিজিলেন্স টিম গঠন। সর্বোপরি  ‘কোয়ালিটি ট্যুরিজম সার্ভিস’কে ট্যুরিজম মাস্টার প্ল্যানের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা।

পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমের ২১  জেলার ভ্রমণ সময় চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়ায় ছুটির দিনে যাদের দৌড় ছিল বড়জোর মাওয়া ঘাটের ইলিশ পর্যন্ত, তারা এখন ছুটির দিনটা সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা সৈকত কিংবা আরও দূরে বিশ্ব ঐতিহ্য  সুন্দরবনে কাটানোর পরিকল্পনা করতেই পারেন। মুন্সীগঞ্জের পদ্মার নদীর ধারে বেড়াতে আর ইলিশ খেতে আসা মানুষের আনাগোনায়  রাতেও পরিণত হয় নাগরিক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার কেন্দ্র হিসেবে। পদ্মার ঝিরঝিরে আঁশটে বাতাস, রঙিন আলোয় সেজে ওঠা পদ্মা পাড়ের রেস্তোরাঁয় বাজতে থাকা মারফতি গান, সঙ্গে ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ- সব মিলে পরিবেশ হয়ে ওঠে অন্যরকম।

পদ্মা সেতুর বদৌলতে পর্যটনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাশাপাশি পদ্মা সেতু সংলগ্ন এবং ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় মুন্সীগঞ্জ-শরীয়তপুর হতে পারে  সম্ভাবনাময় পর্যটন নগরী। নিকট ভবিষ্যতে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক  সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটনে মডেল হবে বাংলাদেশ।

লেখক: সভাপতি, সিএসই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর