শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বাংলাদেশপন্থী রাজনীতিতে শহীদ জিয়া ও তারেক রহমান

মেশকাত সাদিক
প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

বাংলাদেশপন্থী রাজনীতিতে শহীদ জিয়া ও তারেক রহমান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি নক্ষত্রসম অধ্যায়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশপন্থী অনুপম রাজনৈতিক দর্শনের আদর্শ প্রণেতা। প্রাসঙ্গিক কারণেই সেই দর্শনের নাম: বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মূলত বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি বললেও অত্যুক্তি হয় না। এই আদর্শকে ভিত্তি করেই জন্ম নেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে জনমনে কিছু সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ম্যাডাম জিয়ার শাসনামলে এমন প্রশ্ন খুব একটা হালে পানি পায়নি। তবুও আজকে কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি কি আদৌ এখন শহীদ জিয়ার আদর্শের ধারক, নাকি কেবল উত্তরাধিকারসূত্রে নাম বহনকারী একটি রাজনৈতিক কাঠামো মাত্র? এই ধরনের প্রশ্ন যদি বিএনপির ভুলত্রুটি শুধরে দেওয়ার জন্য হতো তাহলে প্রশ্নটিকে শাশ্বত ও যথোপযুক্ত মনে করা যেত। কিন্তু প্রশ্নের ধরন ও প্রশ্নকর্তাদের দেখলেই সন্দেহ জাগে যে এটি শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রশ্ন কিনা। নাকি এর কোনো বাস্তবতা আছে? চলুন আজকের কলামে আমরা এ বিষয়টিকে একটু বিশ্লেষণ করি।

এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কারণ এখানে আবেগ আছে, ইতিহাস আছে, আবার নির্মম বাস্তবতাও আছে। শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ ও সবশেষে দেশের জন্য প্রাণোৎর্গের মধ্যেই তার বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির উজ্জ্বল উপমা খুঁজে পাওয়া যায়।


বিজ্ঞাপন


এক.

জিয়াউর রহমানের রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল রাষ্ট্র তথা দেশ। ব্যক্তি, দল কিংবা ক্ষমতা, কোনোটাই তার কাছে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে ছিল না। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক একদলীয়তার বিপরীতে তিনি যে দর্শন হাজির করেন, তা ছিল বাস্তববাদী ও কার্যকর।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণার মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেন, বাংলাদেশের মানুষ কেবল ভাষাগত পরিচয়ে আবদ্ধ নয়; তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভৌগোলিক বাস্তবতা মিলিয়েই জাতিসত্ত্বার পরিচয় বহন করে। এই ধারণা ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক একচোখা জাতীয়তাবাদের বিপরীতে দুর্দমনীয় সাহসী অবস্থান। একই সঙ্গে জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন, ব্যক্তিখাত ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতিকে উৎসাহ দেন এবং পররাষ্ট্রনীতিতে আত্মমর্যাদাশীল ভারসাম্য বজায় রাখেন। আধিপত্যবাদী কোন দেশকে তিনি তোয়াক্কা করতেন না। দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি ছিলেন অপোসহীন। তার মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য স্ত্রী ম্যাডাম জিয়াও একই আদর্শ লালন করেছেন। ‘জান দেবেন কিন্তু দেশের মান দেবেন না।’ আধিপত্যবাদীদের চোখে চোখ রেখে পারস্পারিক সম্পর্ক (reciprocal) রক্ষা করে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে প্রদক্ষ রাজনীতি ছিল ম্যাডাম জিয়ার। সংক্ষেপে বললে, জিয়ার রাজনীতি ছিল রাষ্ট্র গড়ার রাজনীতি। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে বিএনপির রাজনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি হোঁচট খায়। বিনা কারণে ম্যাডাম জিয়াকে কারান্তরীণ করা হয়। স্লো-পয়জনে তাকে হত্যা করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়, যার ফলে তাঁর শরীরের কিডনি, ফুসফুস, হার্ট এগুলো আক্রান্ত হয়। আজ অব্দি তিনি সেই সমস্ত দূরারোগ্য উপসর্গে ভুগছেন এবং জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন।

বাংলাদেশের মানচিত্রের প্রতীক ম্যাডাম জিয়া। আধিপত্যবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয় ১/১১ পরবর্তী সময়ে। শহীদ জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে উঠছিলেন যে তারেক জিয়া তাকেও জীবননাশের উদ্দেশ্যেই সীমাহীন অত্যাচার করা হয়। সেই অত্যাচারে তার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। তাকে বিদেশ যেতে বাধ্য করা হয়। ১৫ বছর নির্বাসিত থাকা, অসুস্থ মায়ের কাছে আসতে না দেওয়া, আপন ছোট ভাইকে হারানো, নিকটাত্মীয়দের হারানো, জানাজায় আসতে না পারা, বাবার কবর জিয়ারত করতে না পারা, সবকিছু তাকে পুড়িয়েছে। নিদারুণভাবে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। তারপরও দূর থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অসামান্য অবদান রেখেছেন।


বিজ্ঞাপন


ফ্যাসিবাদ পালিয়ে গেল। অবশেষে তিনি দেশে এলেন। লাখো কোটি জনতার সামনে যে বক্তব্য তিনি দিয়েছেন তা যেন তার পিতার-ই বক্তব্যের অনুনাদ-প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের জনগণ এমনই একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক চায়। যিনি দিল্লি শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলবেন। নিজের দেশের স্বার্থ আদায় করবেন। আর তা করতে গিয়ে প্রয়োজনে রক্ত দেবেন। জীবন দেবেন। শহীদ হবেন। তারেক জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপি কিছুটা ভারতপন্থী ও বিশৃঙ্খলপূর্ণ হলেও বর্তমান উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

দুই.

গত ফ্যাসিবাদী আমলে বিএনপি এক দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে গেছে। ক্ষমতার বাইরে থাকা, নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, সব মিলিয়ে দলটি কার্যত একটি প্রতিরোধমূলক রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ নিয়েছিল। কিন্তু আজকের বিএনপির রাজনীতি মূলত গণতন্ত্র ও উন্নয়নকেন্দ্রিক। রাষ্ট্র পরিচালনার বিকল্প দর্শন, অর্থনৈতিক রূপরেখা কিংবা প্রশাসনিক সংস্কারের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দৃশ্যমান।

তারেক জিয়ার রাজনীতি দেশের উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথা বলে, শান্তির কথা বলে। যুগোপযোগী পরিকল্পনার কথা বলে। সবকিছুর পরও জিয়ার আদর্শের সঙ্গে বর্তমান বিএনপির বহুক্ষেত্রেই মিল আছে।

প্রথমত, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান এখনো জিয়ার দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একদলীয় শাসন বা কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে তারেক রহমানের বক্তব্য শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে মিলে যায়।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও বিদেশি প্রভাবের প্রশ্নে বিএনপির সন্দেহ ও সতর্কতা জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির স্মরণ করিয়ে দেয়।

তৃতীয়ত, ধর্মীয় মূল্যবোধকে সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করা। এই দৃষ্টিভঙ্গিও জিয়ার আদর্শের ধারাবাহিকতা।

এত কিছুর পরও কিছু কিছু অমিল সবচেয়ে প্রকট। সবচেয়ে বড় অমিল হলো নেতৃত্বের ধরনে। জিয়া ছিলেন সরাসরি, দৃঢ় ও সিদ্ধান্তমুখী নেতা। পক্ষান্তরে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দূরবর্তী নেতৃত্ব ও প্রতীকী নির্দেশনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এতে মাঠপর্যায়ে কর্মীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তারেক জিয়া দেশে আসার পর সেই সমস্যা কেটে গিয়েছে। এখন জনগণ চেয়ে আছেন, তারেক জিয়া যেন তার পিতার প্রতিচ্ছবিরূপে দ্বিতীয় জিয়া হয়ে উঠবেন।

দ্বিতীয়ত, উৎপাদনমুখী অর্থনীতি ও উন্নয়ন দর্শন ছিল শহীদ জিয়ার রাজনীতির প্রাণ। বর্তমান বিএনপিকে শহীদ জিয়ার এই চ্যাপ্টারগুলো মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করা প্রয়োজন।

তিন.

আজ বিএনপি শহীদ জিয়ার নাম উচ্চারণ করে, তার ছবি ব্যবহার করে, তার শাহাদাতের কথা স্মরণ করে। এটি শুধু বিএনপি নয় সারা বাংলাদেশের মানুষ তার সুশাসনের কথা স্মরণ করে। কিন্তু শহীদ জিয়ার আদর্শ কেবল স্মৃতিফলকেই সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। বাস্তব রাজনীতিতেও তার প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন জীবন্ত করে তোলা জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য।

ইতিহাস বলে, কোনো রাজনৈতিক দল শুধু অতীতের গৌরব দিয়ে টিকে থাকতে পারে না। আদর্শকে সময়োপযোগী করে নতুনভাবে উপস্থাপন না করলে তা কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকে।

জিয়াউর রহমানের আদর্শ বিএনপির জন্য কোনো বোঝা নয়, বরং এটি হতে পারে সবচেয়ে বড় শক্তি, যদি দলটি সেই আদর্শকে নতুন বাস্তবতায় পুনর্গঠন করতে পারে। তা না হলে ইতিহাস একদিন লিখবে, জিয়ার আদর্শ ছিল, কিন্তু উত্তরাধিকারীরা তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের পালস হচ্ছে- বাংলাদেশের রাজনীতি দুই প্রকার। একটি বাংলাদেশপন্থী। আরেকটি ভারতপন্থী। শহীদ জিয়া বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির উদ্ভাবক এবং সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েই তিনি শহীদ হয়েছেন। বিএনপির নেতৃত্বকে এগুলো গবেষণা করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর