আজ ১২ ডিসেম্বর, শুক্রবার সারাদেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর মেধা যাচাইয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে, যা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল অর্জন করা প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পায়।
সরকারি ও বেসরকারি সব মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াটি সারাদেশে একই দিন, একই সময়ে এবং একই প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হয়। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা–২০২৫ নিয়েই আজকের এই লেখার সূচনা।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি ও আর্মড ফোর্সেস মিলিয়ে মোট ১১২টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। মোট আসনসংখ্যা প্রায় ১২ হাজার ১৮৯। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি, বেসরকারি ৬৮টি এবং আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ ৭টি। এ বছর এক লক্ষের বেশি শিক্ষার্থী এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। মেধাগত মানদণ্ডে এদের অনেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ার যোগ্য হলেও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় আনুমানিক ৪০–৫০ হাজার শিক্ষার্থী।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এই ৪০–৫০ হাজার শিক্ষার্থী প্রত্যেকেই এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির যোগ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো—মাত্র প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পায়। ফলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও বাকি ৩০–৪০ হাজার শিক্ষার্থী চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত হয়। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়—শুধু ভর্তি প্রতিযোগিতার তীব্রতার কারণে অনেক প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীও এমবিবিএসে ভর্তি হতে পারে না।
এই ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ; অর্থ বা অন্য কোনো প্রভাব খাটানোর সুযোগ নেই। একই প্রশ্নপত্রে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ—সব জায়গায় ভর্তি সম্পন্ন হয় পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই প্রক্রিয়া সরকারের কঠোর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়ায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ পরিচালনা পর্ষদের কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
অতীতে এ প্রক্রিয়াকে আরও নির্ভুল ও স্বচ্ছ করতে গত দুই–তিন বছর ধরে অটোমেশন যুক্ত হয়েছে। ফলে একজন শিক্ষার্থী তার প্রাপ্ত নম্বর ও পছন্দক্রম অনুযায়ী কলেজ বরাদ্দ পায়—এখানে আর্থিক অবস্থার কোনো ভূমিকা নেই। এরপরও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে নানান ভুল ধারণা রয়ে গেছে।
বিজ্ঞাপন
বহু উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমাকে ফোন করে জানান—তাদের সন্তান বা আত্মীয় উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে এবং তারা চান তাদের সন্তান ডাক্তার হোক। প্রায়ই তারা প্রশ্ন করেন, “কত টাকা লাগবে?” এ ধরনের প্রশ্ন শুনে আমি বিব্রত হই এবং বলতে হয়—মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা সম্পূর্ণ জাতীয় মেধাভিত্তিক একটি প্রক্রিয়া। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্রম সম্পূর্ণ মেধানুসারে নির্ধারিত হয় এবং ভর্তি-সংক্রান্ত খরচও সরকার কর্তৃক নির্ধারিত।
অনেকেই মনে করেন মেডিকেল শিক্ষার খরচ অতিরিক্ত। কিন্তু তুলনামূলকভাবে দেখা যায়—ভারত ও নেপালের প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে একজন চিকিৎসক হতে প্রায় এক কোটি টাকা বা তারও বেশি ব্যয় হয়। সেখানে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের খরচ প্রায় অর্ধেক এবং দেশীয় শিক্ষার্থীদের জন্য তারও কম।
বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার মান অত্যন্ত উন্নত, ব্রিটিশ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং রোগীর সংখ্যার দিক থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ বিশ্বের অন্যতম। গর্বের বিষয়—ভুটানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। নেপালের খ্যাতনামা হৃদরোগ সার্জন ডা. ভগবান কৈরালা বাংলাদেশের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (NICVD) থেকে এমএস ডিগ্রি অর্জন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম বাড়াচ্ছেন।
তা সত্ত্বেও চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এবং হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টির মতো অশুভ প্রবণতা আজও দেখা যায়। আমরা বিশ্বাস করি—রাষ্ট্রের দৃঢ় অবস্থান এসব অপচেষ্টার অবসান ঘটাবে। এসব সমালোচনা মূলত অজ্ঞতা থেকেই আসে।
পরিশেষে বলতে চাই—এখনও বাবা-মায়েদের কাছে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ পছন্দ মেডিকেল শিক্ষা। সামাজিক মর্যাদা, পেশাগত সম্মান ও জীবনের নিরাপত্তার কারণেই চিকিৎসক পাত্র-পাত্রীরা আজও অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। তবুও অজানা কারণে চিকিৎসকদের কর্মপরিবেশ ও সামাজিক মর্যাদা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
তারপরও যারা ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষে মেধার ভিত্তিতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে—তাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।
জয় হোক মেধাবীদের।
লেখক পরিচিতি:
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ইউনিভার্সেল মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
এআর

